ওসিয়ত: মৌলিক নীতিমালা


পূর্বে আমরা একটি পোস্টে ওসিয়ত করার বিধান সম্পর্কে জেনেছি। আজ আমরা ওসিয়তের মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে জানবো।

যারা পূর্বের লেখাটি পড়েন নি তারা নিচের লিংকে ক্লিক করে তা পড়ে নিতে পারেন। 


ওসিয়তের মৌলিক নীতিমালা

১. ওসিয়তকারীর মৃত্যুর পর যারা কোরআন-সুন্নাহর নীতিমালা অনুযায়ী স্বাভাবিক ভাবেই সম্পত্তি পাওয়ার হকদার তাদের জন্য ওসিয়ত করা সঠিক নয়। তাদের ব্যাপারে ওসিয়ত করলে তা কার্যকর হবে না। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إنّ اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ، فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ
মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য তার হক পৌঁছে দিয়েছেন। এখন উত্তরাধিকারীর জন্য কোন ওসিয়ত নেই।[1]
অবশ্য যদি অন্যান্য ওয়ারিশরা তা মেনে নেয় তাহলে তা কার্যকর হবে।[2]

২. ওসিয়ত এর সর্বোচ্চ পরিধি পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ। সাধারণ অবস্থায় এর চেয়ে ‎‎বেশি সম্পদে ওসিয়ত কার্যকর হবে না। এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা রয়েছে।[3] এ বিষয়টি নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত-
عن مصعب بن سعد عن أبيه قال عادنى النبى -صلى الله عليه وسلم- فقلت أوصى بمالى كله. فقلت أوصى بمالى كله. قال « لا ». قلت فالنصف. قال « لا ». فقلت أبالثلث فقال نعم والثلث كثير
অর্থ: প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সা‘দ (রাঃ) বলেনঃ একবার আমি অসুস্থ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে দেখতে এলেন। তখন আমি বললাম, আমি আমার সমুদয় সম্পদের ব্যাপারে ওসিয়ত করে যেতে চাই। তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেকের অনুমতি দিন। তিনি বললেন, না।  আমি বললাম, তাহলে এক তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এক তৃতীয়াংশ হতে পারে, আর এক তৃতীয়াংশও অনেক বেশী।[4]

৩. কোন ব্যক্তি যদি এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তির বেশি ওসিয়ত করে এবং ওয়ারিশরা সবাই বালেগ হয় আর বিষয়টি মেনে নেয় তাহলে তা কার্যকর হবে।[5] এক্ষেত্রে ওসিয়তকারীর মৃত্যুর পর তাদের অনুমতি বিবেচ্য হবে, এর আগে নয়। সুতরাং তারা যদি ওসিয়তকারীর জীবদ্দশায় অনুমতি দেয় এবং তার মৃত্যুর পর অনুমতি না দেয় তাহলে তা কার্যকর হবে না।[6]

৪. যদি মৃত ব্যক্তির কোন ওয়ারিস না থাকে তাহলে অগ্রগণ্য মত অনুযায়ী এক তৃতীয়াংশের বেশী সম্পদে তার ওসিয়ত কার্যকর হবে।[7] এমনকি সে চাইলে তার পুরো সম্পত্তির ব্যাপারেও ওসিয়ত করতে পারে।[8] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এমনটি বর্ণিত আছে।[9]

৫. এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি হিসাব করার ক্ষেত্রে মৃতের দাফন-কাফন ও ঋণ আদায়ের পর অবশিষ্ট পরিত্যাক্ত সম্পদের এক তৃতীয়াংশ বিবেচ্য হবে।[10]

৬. যদি ঋণ আদায়ের ব্যপারে ওসিয়ত করে তাহলে তা সম্পত্তির এক তৃতীয়ংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ‎‎থাকবে না। বরং পুরো সম্পত্তি থেকে কার্যকর করতে হবে।[11]

৭. এক তৃতীয়াংশ সম্পদের ব্যপারে ওসিয়ত করার ক্ষেত্রে ওয়ারিসদের অনুমতির প্রয়োজন ‎‎নেই।[12]

৮. ওসিয়ত কার্যকর হওয়ার জন্য ওসিয়ত শব্দ ব্যবহার করা জরুরী নয়, বরং মৃত্যু পরবর্তীতে সম্পদ প্রদান বুঝায় এমন যে কোন শব্দ বা বাক্য দ্বারাও ওসিয়ত হতে পারে। যেমন বললো, আমার মৃত্যুর পর তোমরা এত টাকা অমুককে দিয়ে দিও, অথবা বললো, আমার মৃত্যুর পর অমুক এত টাকা পাবে ইত্যাদি বাক্য দ্বারাও ওসিয়ত সংঘটিত হবে।[13]

৯. ওসিয়তকারীর মৃত্যুর পর কেবল ওসিয়ত কার্যকর হয়, এর আগে নয়। সুতরাং সে চাইলে মৃত্যুর আগে তা থেকে ফিরে আসতে পারে।[14] এমনিভাবে একবার ওসিয়ত করার পুনরায় সে এর মধ্যে সংযোজন-বিয়োজনও করতে পারে।[15]

১০. ওসিয়তকারী যদি ওসিয়তকৃত বস্তুতে এমন কোন পরিবর্তন করে যার দ্বারা তার মূল সত্তা পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে ধরা হবে, তিনি ওসিয়ত ফিরিয়ে নিয়েছেন।[16] যেমন কাউকে ‎‎কোন কাপড় প্রদানের ওসিয়ত করার পর তিনি নিজেই উক্ত কাপড় কেটে জামা বানিয়ে ‎‎ফেললেন। অবশ্য উক্ত বস্তু নিজে ব্যবহার করার দ্বারা ওসিয়ত বাতিল হবে না।[17]

১১. নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির ব্যাপারে ওসিয়ত করা হলে তা কার্যকর হওয়ার জন্য ওসিয়তকারীর মৃত্যুর পর তার সম্মতি জরুরী।[18] সুতরাং সে যদি ওসিয়ত কবুল না করে ফিরিয়ে দেয় তাহলে তা বাতিল হয়ে যাবে। অবশ্য ওসিয়তকারীর জীবদ্দশায় ফিরিয়ে দিলে তা বাতিল হবে না; বরং  তার মৃত্যুর পর পুনরায় সে চাইলে তা গ্রহণ করতে পারে।[19]

বিবিধ মাসায়েল

১. যদি কেউ তাঁর অনাদায়ী হজ ও যাকাত আদায়ের জন্য ওসিয়ত করে এবং তার রেখে যাওয়া এক তৃতীয়াংশ সম্পদ দ্বারা উভয়টি আদায় করা সম্ভব না হয় তাহলে হজকে প্রাধান্য দিতে হবে।[20]

২. নির্দিষ্ট কোন বস্তুকে সদকা করার ওসিয়ত করলে ওয়ারিশরা চাইলে ঐ বস্তুটি হুবহু সদকা না করে এর মূল্যও সদকা করতে পারে। যেমন কোন ব্যক্তি বললো, আমার মৃত্যুর পর আমার এই কাপড়টি তোমরা সদকা করে দিও। এক্ষেত্রে ওয়ারিশরা যদি ঐ কাপড়টি সদকা না করে এর মূল্য সদকা করে দেয় তাহলেও ওসিয়ত আদায় হয়ে যাবে।[21]

৩. কোন বস্তুর ভোগের জন্য ওসিয়ত করা হলে অগ্রগন্য মত অনুযায়ী যার ব্যাপারে ওসিয়ত করা হয়েছে সে তা কোথাও ভাড়া দিতে পারবে না।[22]

৪. ওসিয়ত গোপন করা বা ওসিয়তকৃত ব্যক্তিকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে গড়িমশি করা অত্যন্ত অন্যায়। যদি কোন ওয়ারিশ এমনটি করে তাহলে অতিসত্বর উক্ত সম্পত্তি তাকে বুঝিয়ে ‎‎দেয়ার পাশাপাশি যে কয়দিন গড়িমশি করা হয়েছে তার ন্যায্য ভাড়া ওসিয়তকৃত ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে।[23]

৫. যদি মৃত ব্যক্তির অনাদায়ী কোন ফরজ বা ওয়াজিব থাকে এবং তিনি এ ব্যপারে ওসিয়ত না করে যান, তাহলে ওয়ারিশদের উচিত ব্যক্তিগত উদ্যোগে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তা আদায় করে দেয়া। আশা করা যায়, এর দ্বারা তিনি আল্লাহর কাছে দায়মুক্ত হবেন। 
হাদীসে এসেছে, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রা. এর মায়ের ইন্তিকালের পর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার মা একটি মানত করেছিলেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দিই তাহলে এর দ্বারা কি তিনি উপকৃত হবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, এর দ্বারা তিনি উপকৃত হবেন।[24]


[1] জামে‘ তিরমিযী-৪/৩৭৭/২১২১, সুনানে নাসাঈ- ৬/৫৭৭/৩৬৪৩-৩৬৪৫, সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৯০৫/২৭১২, সুনানে দারেমী-২/৫১১/৩৬৬০, মুসনাদে ‎আহমাদ-৪/১৮৬,২৩৭‎
[2] বাদায়ে ৭:৪৯৯
[3] তাকমিলা ২:৬৪
[4] সহিহ মুসলিম- ৪১৮৩
[5] বাদায়ে’ ৭:৫৪৪‎
[6] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ১৬৪৫৩‎
[7] তাকমিলা ২:৬৫‎
[8] আন নুতাফ ফিল ফতওয়া, পৃ: ৫০৯
[9] দেখুন: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ১৬৩৭১,১৬৩৭৪‎
[10] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ‎১৯০০৩;সুনানে তিরমিযি- ২২০৫; আস সিরাজী ফিল মিরাস, পৃ: 
[11] আন নুতাফ ফিল ফতওয়া, পৃ: ৫০৩‎
[12] ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৬:৯০‎
[13] ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৬:৯০ আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়া ৪৩:২২৭‎
[14] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ১৬৩৮৫; ফতওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ ৬:৯২‎
[15] আন নুতাফ ফিল ফতওয়া, পৃ: ৫০৪‎
[16] বাদায়ে’ ৭:৫৫৮‎
[17] আন নুতাফ ফিল ফতওয়া, পৃ: ৫০৪‎
[18] ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৬:৯০; ফতওয়ায়ে বায্যাযিয়া ৬:৪৩৩‎
[19] বাদায়ে’ ৭:৪৮৯‎
[20] ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৬:৯
[21] প্রাগুক্ত ৬:১২৩‎
[22] প্রাগুক্ত ৭:৫৬৮; আন নুতাফ ফিল ফতওয়া, পৃ: ৪৯৯
[23] আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাতুল কুয়েতিয়া ৪৩:২৬৭‎
[24] মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ১৬৩৩৪‎

কোন মন্তব্য নেই

nicodemos থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.