ওসিয়ত: যে বিষয়টি আপনার আজই জানা প্রয়োজন
ওসিয়ত শব্দটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি
পরিচিত। আমাদের দাদা, নানা, চাচা অনেকেই মৃত্যুর আগে অনেক কিছু ওসিয়ত করে গেছেন বলে আমরা
প্রায়ই শুনে থাকি। কিন্তু আমরা আদৌ কি জানি, ওসিয়ত
শব্দটি দ্বারা আসলে কী বুঝায়? আমরা কি জানি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওসিয়ত করা আমাদের সবার উপর ওয়াজিব ? এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। ইনশাল্লাহ আমরা কিস্তি আকারে আপনাদের সামনে
ওসিয়ত এর আদ্যোপান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব। আজকের কিস্তিতে আমরা জানব,
১. ওসিয়ত এর পরিচিতি।
২. ওসিয়ত এর গুরুত্ব।
৩. কখন ওসিয়ত করা ওয়াজিব?
পরিচিতি
ওসিয়ত শব্দের আভিধানিক অর্থ: যুক্ত করা, যুক্ত হওয়া, পৌঁছা।[1] আরবী ভাষায় ওসিয়ত শব্দটি দুটি অর্থে
ব্যবহৃত হয়। যথা ১. কোন ব্যক্তিকে তার করণীয় সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে নসিহত বা দিকনির্দেশনা
প্রদান করা। যেমন, পবিত্র কুরআনুল কারীমে
এসেছে,
ووصينا الانسان بوالديه حسنا
অর্থ: আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সাথে
সদাচরনের ওসিয়ত করেছি (নির্দেশ দিয়েছি)। - সূরা আনকাবুত, আয়াত নং: ৮
২. ওসিয়তকারীর মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তার
সহায় সম্পত্তির ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করা।
ওসিয়ত এর পারিভাষিক অর্থ
কোরআন ও হাদিসে ওসিয়ত শব্দটি ব্যাপক অর্থে
ব্যবহৃত হলেও পারিভাষিকভাবে এর অর্থে কিছুটা সংকোচন এসেছে।
প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন মারগিনানী
এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে:
الوصية تمليك مضاف إلى ما بعد الموت
অর্থাৎ ওসিয়ত হলো মৃত্যুপরবর্তী সময়ের
দিকে সম্পৃক্ত করে কাউকে কোন কিছুর মালিকানা প্রদান করা।[2]
অন্যান্য ফুকাহায়ে কেরামও এর কাছাকাছি
সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সবার মতেই পারিভাষিকভাবে ওসিয়ত শব্দটি মৃত্যুপরবর্তী সম্পদের
ব্যপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করার অর্থে ব্যবহৃত হয়।[3]
ওসিয়ত এর গুরুত্ব
মৃত্যুপরবর্তী সম্পদের ক্ষেত্রে ওসিয়ত
করার ব্যাপারে ইসলাম সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামের শুরুর যুগে যখন উত্তরাধিকার
নীতির ব্যাপারে কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়নি, তখন মৃত্যুর আগে ওসিয়ত করে যাওয়া প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ ছিল। পবিত্র কোরআনুল
কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
كتب عليكم إذا حضر أحدكم الموت إن ترك خير ا ۖ الوصية للوالدين والأقربين بالمعروف ۚ حقا على المتقين
অর্থ: তোমাদের মধ্যে কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত
হলে সে যদি ধন-সম্পত্তি রেখে যায় তবে প্রচলিত ন্যায়নীতি অনুযায়ী তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের
জন্য ওসিয়ত করার বিধান তোমাদেরকে দেয়া হলো। এটা মুত্তাকীদের উপর কর্তব্য। (সূরা বাকারা-
১৮০)
এই আয়াতে মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনের জন্য
ওসিয়ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকারনীতির পূর্বে এটি ওয়াজিব ছিলো। উত্তরাধিকারের
নির্দেশাবলী এই ওসিয়তের হুকুমকে মানসূখ করে দিয়েছে। ‘আমর ইবনে খারিজাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত
আছে,
তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে
খুতবার মধ্যে এ কথা বলতে শুনেছি,
إِن اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حق حَقَّهُ، فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِث
‘মহান আল্লাহ প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য
তার হক পৌঁছে দিয়েছেন। এখন উত্তরাধিকারীর জন্য কোন ওসিয়ত নেই।[4]
ওসিয়ত করা কখন ওয়াজিব হয় ?
মৌলিকভাবে ওসিয়ত করা একটি বৈধ ও উত্তম
কাজ। তবে কিছু ক্ষেত্রে
ওসিয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব।
মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন,
مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُوصِي
فِيهِ، يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلَّا وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوبَةٌ عِنْدَهُ
যে মুসলিম ব্যক্তির
নিকট ওসিয়ত করার উপযুক্ত কিছু জিনিস রয়েছে তার জন্য উচিত নয় ওসিয়ত না লিখে
দু’টি রাতও অতিবাহিত করা।[5]
এ হাদীসের ভিত্তিতে ওলামায়ে কেরাম
লিখেছেন, চারটি ক্ষেত্রে ওসিয়ত করে যাওয়া প্রত্যেক
ব্যক্তির উপর ওয়াজিব।
১. যদি আপনার কাছে কারো আমানত গচ্ছিত থাকে এবং এ ব্যাপারে কোন ধরনের সাক্ষী না থাকে।
২. যদি আপনার দায়িত্বে কারো পাওনা ঋণ বা আর্থিক দায় থাকে।
আর্থিক দায় বিভিন্ন হতে পারে যেমন, ঋণ, পণ্যের বকেয়া মূল্য, বকেয়া বাড়িভাড়া, অনাদায়ী বিদ্যুৎ বিল, মোবাইল বা টেলিফোন বিল ইত্যাদি।
১. যদি আপনার কাছে কারো আমানত গচ্ছিত থাকে এবং এ ব্যাপারে কোন ধরনের সাক্ষী না থাকে।
২. যদি আপনার দায়িত্বে কারো পাওনা ঋণ বা আর্থিক দায় থাকে।
আর্থিক দায় বিভিন্ন হতে পারে যেমন, ঋণ, পণ্যের বকেয়া মূল্য, বকেয়া বাড়িভাড়া, অনাদায়ী বিদ্যুৎ বিল, মোবাইল বা টেলিফোন বিল ইত্যাদি।
৩. যদি কোন ব্যক্তি সুদ, ঘুষ, আত্মসাত ইত্যাদি অসৎ
উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে থাকে এবং জীবদ্দশায় তা পূর্ণরূপে সদকা করতে সক্ষম না হয়।
এই তিন ক্ষেত্রে মৃতের কাফন-দাফনের
খরচাদির পর অবশিষ্ট পুরো সম্পত্তি থেকে এই হক আদায়ের ব্যপারে ওসিয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব।[6]
৪. কারো যদি কোন ফরজ বা ওয়াজিব আমল
অনাদায়ী থাকে যেমন, ফরজ হজ, অনাদায়ী যাকাত ইত্যাদি এমনিভাবে অনাদায়ী নামায ও রোজার ফিদয়াও
এর অন্তভূক্ত। এক্ষেত্রে সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ থেকে
এর ব্যপারে ওসিয়ত করে যাওয়া ওয়াজিব।[7]
ইনশাআল্লাহ আগামী পর্বসমূহে আমরা জানব:
১. ওসিয়ত সংক্রান্ত মৌলিক নীতিমালা
২. যে সমস্ত ক্ষেত্রে ওসিয়ত করা বৈধ
৩. শরীয়তের দৃষ্টিতে যে সমস্ত ওসিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।
১. ওসিয়ত সংক্রান্ত মৌলিক নীতিমালা
২. যে সমস্ত ক্ষেত্রে ওসিয়ত করা বৈধ
৩. শরীয়তের দৃষ্টিতে যে সমস্ত ওসিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।
[4] জামে‘ তিরমিযী-৪/৩৭৭/২১২১, সুনানে নাসাঈ- ৬/৫৭৭/৩৬৪৩-৩৬৪৫, সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/৯০৫/২৭১২, সুনানে দারেমী-২/৫১১/৩৬৬০, মুসনাদে আহমাদ-৪/১৮৬,২৩৭
[6] আন নুতাফ ফিল ফতওয়া পৃ: ৫০৩
কোন মন্তব্য নেই