মহানবী 'মুহাম্মাদ' সা. এক আদর্শ মানব
তিনি-
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়; একজন মানুষ; শুধু মানুষই নন, মহান ও আদর্শ মানুষ; একজন সফল, সার্থক, ন্যায়নীতিবান ও কর্মঠ ব্যক্তিত্ব; একজন নির্মোহ নিরহংকার নির্লোভ সাধক; একজন বিদ্যাসাগর ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস, বিদ্বান; বিনয়াবনত, খাওফে ইলাহীর তাড়নায় প্রকম্পিত ইনসান; নূর ও নূরানিয়াতের উৎস, ওহীর বাহক; জগত-শ্রেষ্ঠ কাফেলার সরদার, জামাল, কামাল ও সিদক-সাদাকাতের গ্রাহক।
তিনি-
নিষ্ঠাবান, সদাচারী, স্পষ্টভাষী ও সত্যালাপী; অমায়িক, উদার, আত্মত্যাগী ও আমানতদার; উম্মাহর তরে, দীনের শানে নিবেদিতপ্রাণ ও সৎসাহসী; দয়ালু, দাতা ও পরহিতৈশী; যিনি সৌন্দর্যের সমাহার, করুণার আধার; দীনের ইস্যুতে হীনজ্ঞান করেছেন যে দুনিয়ার সব অফার; নাকচ করেছেন যিনি লাল উট ও হিরে-জাওহার।
তিনি-
যাঁর শৈশব-কৈশোর, জীবন-যৌবন, হায়াত-মামাত প্রতিটা ক্ষণ থেকে বিচ্ছুরিত হতো নূরের ফোয়ারা, আলোর ছটা, সত্যের বিকিরণ, সৌন্দের্যের সমীরণ; যাঁর জীবন বেয়ে উদগীরিত হতো হেদায়েতের আলোকরশ্মি, থমকে যেতো জাহিলায়াতে ভেসে-যাওয়া ঊর্মি, দূর হতো কুফর-শিরকের তাবৎ গোমরাহি।
তিনি-
যাঁর ছোঁয়ায় প্রশান্তিতে ভরে যেতো অন্তরাত্মা, যাঁর কাছে বলা যেতো দিলের সবকথা, যাঁর জন্য ছিল হৃদয়-উৎসারিত সবশ্রদ্ধা, বদন-মনন অকুণ্ঠ মেনে নিত যাঁর কদর মর্যাদা, স্বপ্নের দুলাল হয়ে যিনি বাসা বাঁধতেন পথিকের হৃদরাজ্যে, যাঁর ছবি অঙ্কিত থাকতো আগন্তুকের মনের কাবায়।
তিনি-
আবদুল্লাহর কপাল চমকিয়ে, আমেনার কোল আলোকিত করে খান্দানের ভাগ্যললটে লেপন করেছেন আরবের কেয়াদত। খাদিজার বুকে মাথা রেখে, হেরার গুহায় আশ্রয় নিয়ে পেয়েছেন রবের খালওয়াত। পাহাড়-পর্বত ও জঙলা-ঝুঁপড়ি মাড়িয়ে, গারে-সাওরে মাথা ঠেকিয়ে, সবুজ গম্বুজের মেহমান হয়ে, বিলিয়েছেন হেদায়াত; একজীবনে সয়েছেন জালেমের সব জুলুম মশাক্কাত; চড়-লাথি, শ্রুতিকটু কতো কথা, ইট-পাটকেল, লাঠিসোটা সব সয়ে উদার মনে ক্ষমা করেছেন, আর আশায় থাকতেন- 'আসবে কবে আসমানী সে রবের রহমত'।
তিনি-
যিনি সবরের কষ্টি পাথরে পরিশোধিত হয়ে আরোহণ করেছেন শীর্ষ চূড়ায়; ভবিষ্যতের সাআ'দাত দেখতে পেলেন অতীত আয়নায়; যাঁর দুশমনের ভিত নড়বড় হয়, জালিম শাহীর দম্ভের মসনদ প্রকম্পিত হয় অন্তরাত্মার নির্ভয় দেখে; শোষিত দিনগুলো পেরিয়ে নিজেই হলেন ইনসাফগার শাসক। গভীর রজনীতে মুনিবের দুয়ারে রোনাজারি, দিনের আলোয় শত্রুর সামনে বাহাদুরি, ধূলাবালির তপ্ত ভূমি পেরিয়ে, ঘোড়া বল্লম নিয়ে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি, সফরে-হজরে নিজ সঙ্গী-সাথীদের মাঝে ওহির পয়গাম নিয়ে ছোটাছুটি, এভাবেই চলছিল তাঁর দিনগুজারি।
তিনি-
বদর প্রান্তরে বীর সিপাহি; উহুদ ময়দানে রক্তাক্ত দেহে লড়াকু সেনানী; অভুক্ত পেটে কোদালহস্তে খন্দকের রণকৌশলী; যিনি খাইবারে গিয়ে করেন 'জঙ্গে' ইকদামি; হুদাইবিয়ায়র বৃক্ষতলে তৈরি করেন মরণ-বয়াতের ছাউনি; শিরোস্ত্রাণ গায়ে বীরের বেশে মক্কায় পৌঁছে বিশ্বকে শোনালেন বিজয়-ধ্বনি; করেছেন যিনি লাত-মানাতের ইজ্জতহানী; তায়েফ হুনাইন আওতাস সব পেরিয়ে ফিরে আসেন নিজবাড়ী, মদীনাতুন নবী।
তিনি-
ক্ষুদে কাফেলা সাথে নিয়ে, দীপ্তকণ্ঠে দ্ব্যর্থহীন শব্দে জগৎকে জানিয়ে দিলেন- 'আনান-নাবিয়্যু লা-কাযিব'; হত দরিদ্রতার চাদর মুড়িয়ে অকুণ্ঠ জবানে স্বীকারোক্তি দিলেন- 'লা-আইশা ইল্লা আইশুল আখিরাহ'; পরাশক্তিকে হীনজ্ঞান করে স্পষ্ট ঘোষণা করলেন-- 'লাউক্বাতিলান্না হাত্তা য়ুক্বালা লাই-ইলাহা ইল্লাল্লাহ'; শিরকি সব দাপট দলিত করে বলে উঠলেন-'আল-আন নাগযু, ওয়া লা ইয়াগযু-না'; সাম্য-শান্তি, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও আদর্শ পৃথিবীর আদর্শ নাগরিক উপহার দিয়ে বলে দিলেন- লা-ইয়াদিনানি ফি জাযিরাতিল আরব; জাহিলিয়াতকে পদানত করে গেয়ে উঠলেন সাম্যের শান্তির গান- 'লা-ফজলা লি-আরাবিয়্যন আলা আজামায়্যিন'; তিনিই আবার গজওয়াতুল হিন্দের ঘোষক।
তিনি-
সমবয়সীদের আদর্শ-আইডল; বন্ধুদের উসওয়া-আইকন; ছোটদের অন্তরে উপচে-পড়া শ্রদ্ধার পাত্র; বড়দের চোখে স্নেহাস্পদ; তেজারতে একজন সৎ ও সফল ব্যবসায়ী; প্রেম-ভালোবাসায় মথিত স্ত্রীর প্রিয় স্বামী; ললাটে অঙ্কিত চুমু-খাওয়া সন্তানের সচেতন অভিভাবক; মায়ের চোখের ঠান্ডক; বাবার নয়নমণি; দাদার অন্তর শীতলকারী; জনতার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল।
তিনি-
রণাঙ্গনে বিচক্ষণ সেনাপতি; সফল রাষ্ট্রনায়ক; দরসের আদর্শ মুআল্লিম; খানকাহর মুযাক্কি ও মুসলিহ; ন্যায়নিষ্ঠ গৃহপতি; রণাঙ্গনের বীর মুজাহিদ; ইসলামের বিজয়ঘোষক। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এসবের কী সে উৎস, কোন সে গুণ, কোন সে সীরাত; কোন সে জীবনাদর্শ, যার ব্যাকগ্রাউন্ডে কেবলই সফলতা। এসো হে তরুণ, সে পথেই চলি; তাঁর জীবনাদর্শ আঁকড়ে ধরি।
বুক ছিঁড়ে দেখানো সম্ভব হলে আজকের পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের মানুষ পরিচয়ের প্রাণীগুলোকে, কমসেকম মুসলমান নামধারী দু'পেয়ে মানুষগুলোর কাছে গিয়ে দেখাতাম আর বলতাম, ‘যদি সফলতা চাও, তাঁর পথে চলো। তুমি যেকোন অঙ্গণের হও না কেন; তাঁর সিরাতে পেয়ে যাবে সে অঙ্গনটা। তাঁর জীবন অধ্যায়ের নথিপত্র একটু খুলে দেখো। তিনি তোমার মতোই একজন মানুষ ছিলেন। সাথে সাথে দেখো, কী সে আদর্শ যার ব্যকগ্রাউন্ডে কেবলই সফলতা, যার জলছাপায় ভেসে ওঠে শুধুই সৌভাগ্যের অঙ্কিত রেখা’।
দেখো বন্ধু, তাঁর মাঝে দৃশ্যত বিপরীতমুখী এমন অনেক বিচিত্রগুণের সমাবেশ ঘটেছিল, মানবজাতির ইতিহাসে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা ঘটেনি। তিনি এমন অসহায় যে নিজেকেও নিজের অধীন মনে করেননি। আবার এমন শাসক যে, পুরো দেশ তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি মক্কার সফল ব্যবসায়ী ও বাহরাইনের ধনভাণ্ডারের অধিপতি, আবার এমন অভাবী যে, মাসের পর মাস যাচ্ছে আর তাঁর চুলোয় আগুন জ্বলছে না। তিনি শিয়াবে আবি তালিবের বন্দি ও মদিনার পথের মুহাজির, আবার তিনিই আরবজাহানোর বাদশাহ।
তিনি একসময় ভিটে-মাটি ও সহায়-সম্বলহীন এবং ওহুদের পরাজিত মানব, আবার তিনিই বদর হুদাইবিয়া, খন্দক ও হুনাইনের বিজয়ী পুরুষ। জিবরিলের সামনে উপবিষ্ট বিনয়ী ছাত্র তিনিই, আবার তিনিই সুফফার পাঠশালার প্রধান শিক্ষক। মক্কার দুর্বল প্রতিপক্ষের ক্ষমার ঘোষণাকারী, আবার খাইবারের সবল বাহিনী থেকে প্রতিশোধ-নেওয়া বিশ্বনবী। তিনি আমেনার কোলে এতিম সন্তান, হালিমার দুগ্ধ-শিশু নয়নমণি।
তিনি মক্কার যুবক রাখাল, বসরার সফল ব্যবসায়ী, কাবা প্রাঙ্গণে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনকারী সালিশ ও বিচারক। খাদিজা ও আয়েশার স্বামী, ফাতেমা ও জয়নবের বাবা, হাসান ও হুসাইনের নানা তিনি। তিনি আলীর শ্বশুর আর হামজা ও আবু তালিবের ভাতিজা।
এতোসব কারণে তিনি সবার জন্য আদর্শ হওয়ার পূর্ণ যোগ্য। কোনো ব্যক্তির মাঝে যেকোনো সত্তাই থাকুক না কেন, তাঁর পবিত্র জীবনচরিতে রয়েছে সে অধ্যায়। যে ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হোক না কেন, তাঁর দাস্তানে রয়েছে সে সমাধান। তাই সফল হতে চাইলে তাঁর পথে, কামিয়াব হতে হলে তাঁরই আদর্শে ফিরে যাও, যেতে হবে, যদি তুমি সফল ও সার্থক হতে চাও।
কোন মন্তব্য নেই