উমরি কাযা: একটি দালিলিক আলোচনা
লা-মাজহাবি গাইরে মুকাল্লিদ ও বর্তমান
কালের মওদুদি জামাত ব্যতীত সবার মতেই নামাজের উমরি কাজা আদায় করা ওয়াজিব। এটাকে সর্বসম্মত অভিমতও বলা যায়। কারণ ভ্রান্ত
দলের ইখতেলাফ ধর্তব্য নয়। কেবল তথাকথিত আহলে হাদিস লা-মাজহাবী কিছু আলেমের মতে উমরি
কাজা জরুরি না। তাওবা করলেই মাফ পেয়ে যাবে। তাদের মতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কাজা হলে
কেবল কাজা করতে হয়, এর চেয়ে বেশী হলে কাজা
নিষ্প্রয়োজন। যা স্পষ্ট ভ্রান্ত এবং জমহুর ওলামা মাশায়েখের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ।
গাইরে মুকাল্লিদদের দলিল--
عن أم أيمن أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : لا تترك الصلاة متعمدا ؛ فإنه من ترك الصلاة متعمدا فقد برئت منه ذمة الله ورسوله.
অর্থ: উম্মে আইমান রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমরা ইচ্ছাকৃত
নামাজ ছেড়ো না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে নামাজ ছাড়ে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত
হয়ে যায়। মুসনাদে আহমদ, হাদিস-২৭৩৬৪
যদিও লা-মাযহাবিরা কেয়াসে শরঈর বিরোধিতায়
উঠে পড়ে লাগে কিন্তু সময়মতো স্বার্থসিদ্ধির জন্য বহু নাজায়েজ পন্থার আশ্রয় নেয় তারা।
আর তেমনি তারা সুযোগ মতো কেয়াস করে উমুরি কাজা ওয়াজিব না সেটা বুঝাতে ব্যর্থ চেষ্টা
চালিয়েছে।
তাদের কিয়াস দেখুন--
ইচ্ছাকৃত তরক করা মারাত্মক গুনাহ। যা
কেবল কাযার দ্বারা ক্ষমা পাওয়া সম্ভব না। যেমন ইয়ামিনে গামুস [তথা অতীত কালের উপর কৃত
মিথ্যা শপথ] এর কাফ্ফারা নেই, যেহেতু সেটা ইয়ামিনে
মুআক্কাদা [ভবিষ্যৎ কালের উপর কৃত শপথ] ভঙ্গের চেয়ে আরো ভয়াবহ বিষয়। তাই তার জন্য
তাওবা জরুরি। কাফফারা যথেষ্ট হবে না। আল্লাহ বলেন;
لَا یُؤَاخِذُكُمُ ٱللَّهُ بِٱللَّغۡوِ فِیۤ أَیۡمَـٰنِكُمۡ وَلَـٰكِن یُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ ٱلۡأَیۡمَـٰنَۖ فَكَفَّـٰرَتُهُۥۤ إِطۡعَامُ عَشَرَةِ مَسَـٰكِینَ مِنۡ أَوۡسَطِ مَا تُطۡعِمُونَ أَهۡلِیكُمۡ أَوۡ كِسۡوَتُهُمۡ أَوۡ تَحۡرِیرُ رَقَبَةࣲۖ فَمَن لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ ثَلَـٰثَةِ أَیَّامࣲۚ ذَ ٰلِكَ كَفَّـٰرَةُ أَیۡمَـٰنِكُمۡ إِذَا حَلَفۡتُمۡۚ وَٱحۡفَظُوۤا۟ أَیۡمَـٰنَكُمۡۚ كَذَ ٰلِكَ یُبَیِّنُ ٱللَّهُ لَكُمۡ ءَایَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ
অর্থ: আল্লাহ তাআলা ইয়ামিনে লাগব-এর
জন্য পাকড়াও করবেন না। তবে ইয়ামিনে মুআক্কাদ-এর জন্য পাকড়াও করবেন। তার কাফফারা
হলো...
(সূরা মায়েদা আয়াত ৮৯)
আইম্মায়ে আরবাআ এবং জমহুর মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরামের দলিল।
যদিও ইমাম আবু হানিফা রহ-এর মতে যেসব
দলিলের মাধ্যমে নামাজ আদায় করা ওয়াজিব হয় সেগুলির মাধ্যমেই নামাজ কাযা আদায় করা
ওয়াজিব। নতুন দলিলের প্রয়োজন নেই। তদুপোরি ইমাম শাফেয়ি রহ. এর মতে কাজার জন্য নতুন
দলিল জরুরি। অবশ্য বহু শাফেয়ি ওলামা-মাশায়েখ বলেছেন, 'তাফবীত' তথা ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দেওয়াই কাজা ওয়াজিবের
সবব তথা কারণ।
তথাপি কোরআন ও হাদিসে কাজা নামাজ ওয়াজিব
হওয়ার অসংখ্য দলিল পাওয়া যায়।
প্রথম দলীল
কাজা রোজা ওয়াজিব হওয়ার দলিল--
وَمَن كَانَ مَرِیضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرࣲ فَعِدَّةࣱ مِّنۡ أَیَّامٍ أُخَرَۗ یُرِیدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡیُسۡرَ وَلَا یُرِیدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ وَلِتُكۡمِلُوا۟ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا۟ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ
- যে অসুস্থ অথবা মুসাফির সে যেন অন্যদিনে
রোজার কাজা করে নেয়.. (সুরা বাকারা ১৮৫)
ইবাদতের মধ্যে নামাজ হলো সর্বোত্তম ইবাদত।
রোজার ক্ষেত্রে যদি কাজার বিধান আসে। নামাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন হবে কোন যুক্তিতে? কাজা নামাজও অবশ্যই পালনীয়।
দ্বিতীয় দলীল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
إنه ليس في النوم تفريط، إنما التفريط في اليقظة، فإذا نسي أحدكم صلاة، أو نام عنها، فليصلها إذا ذكرها
অর্থ: ঘুমের মধ্যে নামাজ ছুটে গেলে গুনাহ
নাই,
গুনাহ হবে জাগ্রত অবস্থায় নামাজ ছেড়ে দিলে। তোমাদের কেউ ভুলে
অথবা ঘুমের কারণে নামাজ ছুটে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্রই তা আদায় করে নিবে।
সুনানে তিরমিযি হাদিস নং-১৭৭ # সুনানে নাসাঈ-৬১৫ # সুনানে ইবনে মাজা- ৬৯৮
ইমাম তিরমিযি বলেন হাদিসটি হাসান সহিহ।
তৃতীয় দলীল:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-إِذَا رَقَدَ أَحَدُكُمْ عَنِ الصَّلاَةِ أَوْ غَفَلَ عَنْهَا فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَقُولُ أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى.
অর্থ: যখন তোমাদের কেউ নামায ছেড়ে ঘুমিয়ে
পড়ে,
বা নামায থেকে গাফেল হয়ে যায়, তাহলে তার যখন নামাযের কথা মনে পড়বে তখনই সে যেন তা আদায় করে
নেয়। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-আমাকে স্মরণ হলে নামায আদায় কর।
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬০১ #মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১২৯৩২ #সুনানে বায়হাকী
কুবরা,
হাদীস নং-৪১৮২
চতুর্থ দলীল:
নবিজির আমল।
عن عبد الله بن مسعود قال : قال عبد الله : إن المشركين شغلوا رسول الله صلى الله عليه وسلم عن أربع صلوات يوم الخندق، حتى ذهب من الليل ما شاء الله، فأمر بلالا فأذن، ثم أقام فصلى الظهر، ثم أقام فصلى العصر، ثم أقام فصلى المغرب، ثم أقام فصلى العشاء.
অর্থ: ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, খন্দকের যুদ্ধে মুশরিকরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
কে চার ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে দেয়নি। রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর নবীজি
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলাল রা. কে আজান দিতে বললেন, আজান ইকামতের পর তিনি জোহর পড়লেন, অনুরূপ আসর, মাগরিব, এশার নামাজ আদায় করেন।
সুনানে তিরমিযি ১৭৯ সুনানে নাসাঈ ৬৬২
পঞ্চম দলিল; নবীজীর বক্তব্য:
عن أنس بن مالك قال : سئل رسول الله صلى الله عليه و سلم عن الرجل يرقد عن الصلاة أو يغفل عنها قال : كفارتها يصليها إذا ذكرها
অর্থ: হযরত আনাস বিন মালিক রাযি. থেকে
বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নামায রেখে ঘুমিয়ে যাওয়া ব্যক্তি
ও নামায সম্পর্কে গাফেল ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন-এর কাফফারা হল
যখনই নামাযের কথা স্মরণ হবে তখনই তা আদায় করে নিবে।
সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-৯৯১, মুসনাদে আবী আওয়ানা, হাদীস নং-১০৪১, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৩০৬৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৩২৬২, সুনানে
নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-১৫৮৫
ষষ্ঠ দলীল:
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর ফতোয়া-
المسارعة الى قضاء الفوائت الکثيرة أولى من الأشتغال بالنوافل، واما مع قلة الفوائت فقضاء السنن معها احسن.
অনুবাদ-
যদি কাযা নামাযের পরিমাণ অনেক বেশি হয়, তবে সুন্নাত নামাজে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে ফরজ নামাজসমূহ আদায়
করাই উত্তম। আর যদি কাজা নামাজের পরিমাণ কম হয়,তবে ফরযের সাথে সুন্নাত নামাজ আদায় করলে
তা একটি উত্তম কাজ হবে। (ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া-২২/১০৪)
ফিকহে হানাফির ফতোয়া ও অনুরূপ।
দেখুন, আদ্দুররুল মুখতার, ২/ ৬৮; ফাতাওয়া দারুল উলুম,৪/৩৩২
গাইরে মুকাল্লিদের কেয়াসের জবাব।
তাদের উক্ত কেয়াস করাটা মোটেই সহিহ হয়নি, কারণ ইয়ামিনে গামুস [তথা অতীত কালের মিথ্যা শপথ] হলো মুয়ামালা
আর নামাজ হলো ইবাদত। সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদত, ঈমানের দ্বিতীয় স্তম্ভ। একটা অপরটার উপর কিভাবে কেয়াস হতে পারে!
বড় বড় চার ফকিহ মুজতাহিদ গণের ঐক্যমত
যে,
অনিচ্ছায় ছুটে যাওয়া নামাজের কাজা যেমন ওয়াজিব অনুরূপ ইচ্ছাকৃত
ছেড়ে দেওয়া নামাজের কাজা করা ওয়াজিব। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি
রহ. বলেন--
ألحق الفقهاء التفويت بالفوات
অর্থাৎ মুজতাহিদ ফকিহগণ ছুটে যাওয়া নামাজের
সাথে ছেড়ে দেওয়া নামাজকে যুক্ত করে সবধরণের উমুরির কাজা ওয়াজিব করেছেন।
--তুহফাতুল আলমাঈ-১/৪৮০
এসব বর্ণনা প্রমাণ করে নামায মূলত ছেড়ে
দিলেও তার দায়িত্বে থেকে যায়, মাফ হয়না। তাই সময় সুযোগ পেলেই উমরি কাজা নামায আদাই করে নিতে হবে। নামাযের মত গুরুত্বপূর্ণ
ইবাদত কাজা হবার পর তা উদাসীনতার সাথে আদায় না করা চরম গাফলতির লক্ষণ। আর নিজে সে ইবাদত
কাজা না করে এক ধরণের অন্যায় করে সেই সাথে অন্যকে ফাতওয়া দিয়ে কাজা আদায় করতে বিরত
রাখাটা চরম পর্যায়ের ইবাদত বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতিফলন ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। তাই
এসব গোমরাহ পথভ্রষ্টদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরূরি।
والله أعلم بالصواب
তামজীদুল মাওলা কাসেমি
২৪. ১০. ২০১৯ ঈসায়ি।
কোন মন্তব্য নেই