করোনায় কোরবানি: শরয়ী সমাধান


কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত । আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার অনন্য প্রতীক এ কুরবানী। এই কুরবানীর মাধ্যমেই আল্লাহর নির্দেশ পালন ও ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম।

জিলহজ মাসের ১০ তারিখ এ কুরবানী করা হয়ে থাকে। এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর অন্যতম খুশির দিন। এ দিনকে ঈদুল আজহা বলা হয়। (মুস্তাদরাকে হাকেম, ২/৪২২, হাদীস নং ৩৪৬৭,আল-ইখতিয়ার, ৫/১৬,)

নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর কোরবানী করা ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম যুফার, রবিআহ, লাইস বিন সাআদ, আওযায়ী, সুফিয়ান ছাওরী রহ. সহ আরো অনেক ফুকাহায়ে কেরাম এই মত ব্যক্ত করেছেন। (আন-নুতাফু ফিল-ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা, ১৫৪, তুহফাতুল ফুকাহা, ৩/৮১, আল-বাহরুর রায়েক, ৮/৩১৮, আল-ইখতিয়ার, ৫/১৬)

কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার দলীল-
ক. আল্লাহ তায়ালা বলেন: فصل لربك وانحر
অর্থ: তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কোরবানী দাও’। ( সুরা আল-কাওছার : ২ ) 
এখানে আল্লাহ তায়ালা আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা সাধারণভাবে আবশ্যকতা বুঝায়। আর রাসুল (স)-এর জন্য আবশ্যক হলে তা উম্মতের জন্যও আবশ্যক। (সুনানে বায়হাকী, ৯/৪৩৫, হাদীস নং ১৯০০৫, তুহফাতুল ফুকাহা, ৩/৮১)

খ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: من وجد سعة فلم يضح فلا يقربن مصلانا
অর্থ: সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহমাদ, ২/৩২১, হাদীস নং ৮২৭৩,মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪/২৫৮, হাদীস নং ৭৫৬৫, সুনানে বায়হাকী, ৯/৪৩৭, হাদীস নং ১৯০১৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা, ৩৪০, হাদীস নং ৩১২৩ )
ইমাম হাকেম বলেছেন: হাদীসটি সহীহ। হাফেয যাহাবীও বলেছেন: হাদীসটি সহীহ। 

হাদিসটিতে কোরবানী পরিত্যাগকারীদের প্রতি কঠিন সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সতর্কবার্তা সাধারণত ওয়াজিব পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারেই দেওয়া হয়। ( আল-বাহরুল রায়েক, ৮/৩১৮, আল-ইখতিয়ার, ৫/১৬)



কুরবানী সম্পর্কে নবীজীর দৃষ্টিভঙ্গি-

এ দিন সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
ما عمل آدمى من عمل يوم النحر أحب إلى الله من إهراق الدم
অর্থ: ঈদুল আজহার দিনে পশু কুরবানীর চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহ তাআলার নিকট নেই। (সুনানে তিরমিযী, পৃষ্ঠা, ২৬৩, হাদীস নং ১৪৯৩, সুনানে বায়হাকী, ৯/৪৩৮, হাদীস নং ১৯০১৫, ) 
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন: হাদীসটি হাসান।

সম্প্রতি
প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে ঘনিয়ে আসছে কুরবানী। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী আগামী ১লা আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে কোরবানী। এবারের কুরবানীর রূপরেখা কেমন হবে ? মহামারির এ সময়ে মানুষের কুরবানীর ভাবনা কেমন হওয়া উচিত?
এ নিয়ে ইতিমধ্যে চলছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। চলছে আলোচনা-টকশো। করোনায় কুরবানীর ব্যাপারে মানুষের করণীয় কী? এ সম্পর্কেও রয়েছে মানুষের অনেক জিজ্ঞাসা।

মৌলিকভাবে এব্যাপারে মানুষের জিজ্ঞাসাগুলো হলো-

১. কুরবানীর পশুর হাট মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে । তাই সেক্ষেত্রে বিকল্প কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?
২. এবার করোনায় কুরবানী না করে এ টাকা গরীব-অসহায়দের মাঝে দান করলে কুরবানীর দায়িত্ব আদায় হবে কি?
৩. অনেকে প্রতি বছর স্বাভাবিকভাবেই কুরবানী করতেন। এবার অর্থ সংকটের কারণে কুরবানী করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের জন্য করণীয় কী হতে পারে?
৪. দেশের বাইরে প্রবাসে এমন অনেক লোক আছেন যারা এবার পরিস্থিতির কারণে সেখানে কুরবানী করতে পারছেন না, তারা কোরবানীর এ বিধান কিভাবে পালন করবেন ?

চলুন এ চারটি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমরা কিছু আলোচনা করি-

১. কুরবানীর পশুর হাট প্রসঙ্গ-
সরকারী অনুমতিতেই সারাদেশে সবকিছু খোলা রয়েছে। সবধরনের দোকান, সব রকমের হাট। তবে সেখানে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। তাহলে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে কোরবানীর হাট খোলা রাখাতে সমস্যা কোথায়? সবকিছু খোলা রেখে শুধুমাত্র কোরবানীর হাট বন্ধ করা কি হাস্যকর নয়? 
উপরন্তু বর্তমানে করোনার কারণে অনেক কিছুই অনলাইনে কেনা-বেচা চলছে। তাহলে যারা বোঝেন তারা যদি অনলাইনে গরু-ছাগল কেনা-বেচা করেন তাহলে ঝুকি আরো কমে যায়। 
সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা মানুষকে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে বা অনলাইনে গরু-ছাগল বেচা- কেনা করতে উৎসাহিত করতে পারি। তা না করে একেবারে গরু-ছাগল বেচা-কেনা বন্ধ করে দেয়াটা একবোরেই সঙ্গত নয়। 
এমন অনেক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা লক্ষ-কোটি টাকা কুরবানী উপলক্ষে পশুতে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। কেননা কুরবানীর একটি মৌসুমের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা বছরব্যাপী জীবিকা অর্জন করে থাকেন।
তাই এসব বিবেচনায় কুরবানী বন্ধ নয়, কুরবানীর পশুর হাটও বন্ধ নয় বরং যথাযথ স্বাস্থ্য নিরাপত্তার মাধ্যমে এটি অব্যাহত রাখতে হবে।

এছাড়াও এক্ষেত্রে আমরা আরো দুটি পন্থা অনুসরণ করতে পারি। যথা:
ক. মধ্যপ্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মতো সরকারী ব্যবস্থাপনায় অথবা সরকার অনুমোদিত সংস্থার অধীনে নাম রেজিস্ট্রেশন করে কোরবানি করা যেতে পারে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ কাজ সম্পন্ন করবে, ফলে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

খ. মানুষের কল্যাণ বিবেচনা করে ও কোরবানীর বিধান পালনের সুবিধার্থে যেহেতু জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ এ তিন দিন পর্যন্ত কোরবানী আদায় করার সুযোগ রয়েছে সেহেতু সকলেই ১০ তারিখে একত্রে ভিড় না করে বরং প্রত্যেক এলাকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত করে পর্যায়ক্রমে ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে কোরবানী সম্পন্ন করতে পারি। (আন-নুতাফু ফিল-ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা, ১৫৪,  আল-ইখতিয়ার, ৫/১৯)

২. কুরবানী না করে টাকা দান করা-
যদি কেউ কুরবানি না করে সে অর্থ (টাকা-পয়সা) দান করে দেয় তাতে পশু কুরবানীর দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পাওয়া যাবে কি না? 
ইসলামী শরীয়া বিশেষজ্ঞদের (ফুকাহায়ে কেরাম) মতে, এ বিষয়টির সুস্পষ্ট ও সরল উত্তর হলো- কুরবানী না করে এ টাকা দান করা হলে কুরবানীর আমল বা ইবাদত থেকে দায়মুক্তি হবে না। বরং কোরবানীই করতে হবে। 
কারন, কোরবানী ওয়াজিব। পক্ষান্তরে দান-সাদকাহ নফল। কোনো নফল বিধান ওয়াজিব বিধানের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। তাছাড়া কোরবানীর ব্যাপারে সরাসরি কোরআন ও সুন্নাহে নির্দেশ রয়েছে। (ফতোয়া হিন্দিয়া , ৫/৩৬০, আল-ইখতিয়ার, ৫/১৭,রদ্দুল মুহতার, ৯/৪৫৪,৪৬৩)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিঈন, তাবে তাবিঈগণের কেউ কোরবানী না করে সে অর্থ দান-সাদকাহ করেছেন মর্মে কোনো প্রমাণ নেই। 
উপরন্তু, শরীয়তের প্রতিটি বিধানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে, যাকে মাকাসীদুশ শরীয়াহ বলা হয়। তাই যে বিধান আল্লাহ যেভাবে অবতীর্ণ করেছেন সেবিধান সেভাবে পালন করাই আমাদের দায়িত্ব। 


তাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কোরবানী বিধান পালন করতে হবে। কোরবানী পরবর্তী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

৩. করোনায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা-
বিগত বছর কুরবানী দেয়া ব্যক্তি অর্থকষ্টের কারণে এবার কুরবানী দিতে পারছে না, এক্ষেত্রে তার করণীয় কী? 
এক্ষেত্রে শরয়ী সমাধান হলো, নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই কেবল কোরবানী ওয়াজিব হয়। সুতরাং যার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকবে না তার উপর কোরবানী ওয়াজিবও হবে না। ( আল-বাহরুল রায়েক, ৮/৩১৮, ফতোয়া হিন্দিয়া , ৫/৩৬০, রদ্দুল মুহতার, ৯/৪৫৩, আল-ইখতিয়ার, ৫/১৬ )

৪.প্রবাসীদের কুরবানী-
বিদেশে এমন অনেক মুসলমান রয়েছেন, যারা সেখানে কোনো বিধি-নিষেধ, আইনি জটিলতা বা করোনার সংক্রান্ত কোনো কারণে কুরবানী দিতে পারছেন না। তাদের করণীয় কী?

তাদের করণীয় হলো, তারা যেখানে অবস্থান করছেন, যদি সেখানে কুরবানী করতে না পারেন তবে নিজ নিজ দেশে কিংবা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে তার কুরবানী করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে যেখানে তার লোকজন রয়েছে তাদের মাধ্যমে তিনি কুরবানী করবেন। কুরবানির জন্য টাকা পাঠিয়ে দিলে তার পক্ষ থেকে যে কেউই কুরবানী দিতে পারবে। (আন-নুতাফু ফিল-ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা, ১৫৪, আল-বাহরুল রায়েক, ৮/৩১৭, ফতোয়া হিন্দিয়া , ৫/৩৬৬, রদ্দুল মুহতার, ৯/৪৬১)।

আবার যারা দেশে অবস্থান করছেন কিন্ত নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজে কুরবানীর ব্যবস্থা করতে পারছেন না, তাঁরাও অন্য কারো মাধ্যমে দেশের অন্য কোথাও দায়িত্ব দিয়েও কুরবানীর ব্যবস্থা করতে পারেন। তারপরও কুরবানীর এ গুরুত্বপূর্ণ আমল ও ইবাদতটি যথাযথভাবে পালন করতে হবে। 

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনাকালীন এ সময়ে যথাযথভাবে কুরবানী করে তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের তাওফিক দান করুন এবং অতিসত্বর এ মহামারি থেকে সারা বিশ্বের সকল মানুষকে মুক্তি দান করুন। আমীন।

লিখেছেন
মাওলানা রফিকুল ইসলাম

গ্রন্থপঞ্জি-
আল-কুরআনুল কারীম, মুসনাদে আহমাদ, সহীহ বুখারী, মুস্তাদরাকে হাকেম, সহীহ ইবনে হিব্বান,  সুনানে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে বায়হাকী, তুহফাতুল ফুকাহা, আন-নুতাফু ফিল-ফাতাওয়া,আল-বাহরুল রায়েক, ফতোয়া হিন্দিয়া, আল-ইখতিয়ার,রদ্দুল মুহতার।

কোন মন্তব্য নেই

nicodemos থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.