ছোঁয়াচে রোগীদের ক্ষেত্রে সালাফের আমল


পূর্বে আমরা একটি পোস্টে ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জেনেছি। এই পোস্টে আমরা জানবো, ছোঁয়াচে রোগীদের ক্ষেত্রে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম , সাহাবায়ে ‎কেরাম ও তাবেঈগণ কী পদ্ধতি গ্রহণ করতেন সে বিষয়ে জানা প্রয়োজন। নিচে ‎তাদের আমলী পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো:‎

মূলত এসকল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা আর না থাকা উভয় পদ্ধতিই অবলম্বন করা বৈধ। এসব ক্ষেত্রে নবীজী, সাহাবায়ে কেরাম ও ‎তাবেঈদের আমলও দু’ধরনের।

১. ছোঁয়াচে রোগী থেকে দূরত্ব অবলম্বন করা। 



১. সাকীফ গোত্রের এক কাফেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ‎বায়আত হতে এলো। তারা বাইয়াত গ্রহন করার পর বললো আমাদের সাথে এক ‎ব্যাক্তি এসেছে। সে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‎তাকে বললেন: ‎قَدُ بَايَعْنَاكَ فَارْجِعْ‎  অর্থ:    তুমি ফিরে যাও, তোমার বায়আত হয়ে ‎গেছে। ( সহীহ মুসলিম, পৃষ্ঠা: হাদীস নং: ৫৯৫৪,‎

২. একবার ওমর রা. সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ‎পথিমধ্যে সাহাবীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ এসে বললেন: শামে মহামারির ‎প্রদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তখন ওমর রা. সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করলে ‎তাদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দিলো। তখন কোরাইশদের মধ্যে বড়রা সকলেই ‎বললেন যে, আপনি শামে যাবেন না। বরং মদীনায় ফিরে চলুন। তখন ওমর রা. ‎শামে না গিয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। ( মুয়াত্বা মালেক, হাদীস:২৬৩৩)‎

৩.উমর রা. ‎মুআইকীব রা. কে বললেন:   ‎‏ اجلس منى قيد رمح‎ অর্থ: তুমি আমার থেকে ‎এক বর্ষা পরিমাণ দুরে থাকো। আর ‎মুআইকীব রা. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ‎ছিলেন।(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)।

৪.ইবনে হাবীব রহ. বলেছেন:  ‎يمنع المجذوم من المسجد والدخول بين الناس واختلاطه بهم‎  অর্থ: ‎কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মসজিদে আসতে, মানুষের কাছে গিয়ে তাদের ‎সাথে মেলা-মেশা করতে বাধা দিতে হবে।(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)।

৫. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত  এক মহিলা তাওয়াফ করছিল। উমর রা. বললেন: ‎اقعدى فى ‏بيتك ولاتؤذى الناس.  ‏‎ অর্থ: তুমি ঘরে থাকো, মানুষকে কষ্ট দিও না। (শরহু ইবনে ‎বাত্তাল,১৮:১৪)।

৬. আমর ইবনুল আস (রা.)- তার সময়ে মহামারি রোগকে কেন্দ্র করে  মানুষের ‎উদ্দেশে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘হে লোকেরা, এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তা ‎আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও। এক বর্ণনা ‎মতে, তোমরা পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন উপত্যকায় চলে যাও।’ অতঃপর সবাই ‎বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে আল্লাহ ‎তায়ালা এই বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করেন। আমর (রা.)-এর গৃহীত পন্থা খলিফা ‎উমর (রা.) জানতে পারেন। তিনি তা অপছন্দ করেননি। (ফাতহুল বারি, ১০/১৯৯)‎

৭.ইকরিমা রহ. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকতেন।(শরহু ইবনে ‎বাত্তাল,১৮:১৪)।

২. ছোঁয়াচে রোগী থেকে দূরত্ব অবলম্বন না করা।


১.একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ‎হাত ধরে দস্তরখানে বসালেন ও বললেন: ‎‏ كل ثقة بالله وتوكلا عليه ‏‎ অর্থ:আল্লাহর উপর ‎ভরসা করে খাও।

২.একবার সাকীফ গোত্র আবু বকর রা. এর নিকট আসলো। সেখানে খাবারের ‎ব্যবস্থা করা হলে এক ব্যক্তি দূরে থাকলো। আবু বকর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কি ‎হয়েছে তোমার? সে বললো: আমি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। আবু বকর রা. তখন ‎তাকে ডেকে তার সাথে খাবার খেলেন।

৩. সালমান ফারসী ও ইবনে ওমর রা. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য খাবার ‎তৈরী করতেন ও তাদের সাথে খাবার খেতেন।

পাঠক! উপরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , সাহাবায়ে কেরাম ও ‎তাবেঈদের বিভিন্ন আমল জানলেন। তাই আপনিও দূরে থাকা-না থাকা যে কোন ‎একটি পথ অনুসরণ করতে পারেন। এতে অসুবিধার কিছু নেই।

হাদীস থেকে শিক্ষা:‎

পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় উপরে দু'রকমের হাদীস জেনেছেন। এক হাদীসে বলা ‎হয়েছে যে, রোগ সংক্রমণ নেই। অপর এক হাদীসে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ‎থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এই বিষয়টিও জেনেছেন যে, এ সংক্রান্ত দু’ধরনের হাদীসেরে মধ্যে মূলত বৈপরিত্য ‎নেই।

আল্লামা ওয়াসীম ফাতহুল্লাহ বলেন: উপরোক্ত হাদীস থেকে শিক্ষণীয় দুটি বিষয় ‎হলো:‎
১. এক দৃষ্টিকোণ থেকে রোগ সংক্রমণ করে। আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে রোগ ‎সংক্রমণ করে না।আল্লাহই কিছু কিছু রোগের মধ্যে সংক্রমণের ক্ষমতা দিয়েছেন সে হিসেবে রোগ ‎অন্যত্র সংক্রমণ করে। তবে নিজস্ব ক্ষমতা বলে রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করে না।
২. বিভিন্ন আসবাব অর্থাৎ বাহ্যিক উপকরণে আল্লাহ প্রদত্ত কিছু শক্তি থাকে। তবে ‎তা তার নিজস্ব শক্তি নয়। (তুহফাতুল আতীব্বা মিন কালামি খায়রিল ‎আম্বীয়া,১:১৪)।


পাঠক নিশ্চয় উপরে বিভিন্ন হাদীস ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , ‎সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের বিভিন্ন আমল জেনেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে ‎না যে, বিজ্ঞ ফুকাহা ও উলামায়ে কেরামের পক্ষেই কেবল এই বিভিন্নমুখী হাদীস ‎ও আমলের সঠিক মর্মার্থ ও  উদ্দেশ্য বোঝা সম্ভব। তাই এসকল ক্ষেত্রে ‎জনসাধারণের জন্য আবশ্যক হলো উলামায়ে কেরামের নির্দেশনা অনুসরণ ‎করা।আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে সঠিকভাবে বোঝার তাওফীক দান করেন। আমীন।

লিখেছেন- ‎
মাওলানা রফিকুল ইসলাম

গ্রন্থপঞ্জি :-
আল-কুরআনুল কারীম
তাফসীরে কুরতুবী
সহীহ বুখারী
সহীহ মুসলিম
ফাতহুল বারী
শরহু ইবনে ‎বাত্তাল
মুয়াত্বা মালেক
শরহুয যুরক্বানী
আল-আরফুশ শাযী
আল-ফাজরুস ‎সাতে
আল-মিন্নাতুল কুবরা
তুহফাতুল আহওয়াযী
উমদাতুল ক্বারী
আউনুল ‎ওয়াদুদ
ফয়যুল বারী
মিরক্বাতুল মাফাতীহ
বাযলুল মাজহুদ।

কোন মন্তব্য নেই

nicodemos থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.