নিভৃতচারী এক জ্ঞানতাপসের কথা
হযরত মাওলানা আবুল হাশেম রহ.
'(জন্ম : ১৯০৭ খৃষ্টাব্দ । ইন্তিকাল : ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দ) ।
প্রাক্তন মুহাদ্দিস. জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
জন্ম : ১৯০৭ খৃষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খাকচাইল
গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম
হাজী মুহাম্মদ আব্দুস সুবহান ও মাতার নাম ফুলের মা।
শৈশবকাল : তিনি প্রথমে তার পিতা কর্তৃক নির্মিত খাকচাইল হাজী বাড়ির মকতবে উত্তমভাবে কুরআন মাজিদের তিলাওয়াত, প্রয়োজনীয় মাসায়েল শিক্ষালাভ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি মেধা ও অদম্য সাহসের অধিকারী ছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : তিনি ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে পার্শ্ববর্তী গ্রাম বড়হরণ প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উক্ত বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।
পঞ্চম শ্রেণির মেধা যাচাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে টেলেন্টপুলে বৃত্তি লাভ
করেন। ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে ৪১ বছর বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া
ইসলামিয়া ইউনুসিয়ায় ইয়াযদহম জামায়াতে ভর্তি হন। অত্র প্রতিষ্ঠানে
তিনি জামায়াতে শরহে জামী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।
উচ্চশিক্ষা : উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে তিনি জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। অত্র প্রতিষ্ঠানে শরহে বেকায়া জামায়াতে ভর্তি হয়ে সুনামের সাথে দাওরায়ে
হাদীস সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে পাকিস্তানের করাচীর নিউ
টাউনে আল্লামা ইউসুফ বিননূরী রহ. এর মাদরাসায় কুরআনুল কারীমের তাফসীরের উপর বিশেষ কোর্স সমাপ্ত করেন। তাফসীর শিক্ষার দরসে
তিনি হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রহ.এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
কর্মজীবন : ১৯৬২ খৃষ্টাব্দে সিলেট হবিগঞ্জ মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয়। উক্ত মাদরাসায় তিনি দুই বছর খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর তিনি তার নিজ গ্রাম খাকচাইলে হোসাইনিয়া কাসেমুল উলুম নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে রায়ধর, জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকার বড়কাটারা মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরস দান করেন। ১৯৮৩ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯৯২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত পুরান ঢাকার তাতীবাজারস্থ জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়ায় শাইখুল হাদীস পদে নিযুক্ত হয়ে দরসে বুখারীর তা’লীম অত্যন্ত সুনামের সাথে আঞ্জাম দেন। তাঁর কর্মজীবনের শেষ প্রতিষ্ঠানের নাম মিফতাহুল উলুম মাদরাসা মধ্যবাড্ডা, ঢাকা।
১৯৯৩ খৃষ্টাব্দে তিনি উক্ত মাদরাসায় শাইখুল হাদীস পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
এবং ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দে প্রাতিষ্ঠানিক তা’লীম থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
উল্লেখযোগ্য উসতাযগণ : তার উল্লেখযোগ্য উসতাযগণের মধ্যে ছিলেন
হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ., ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ, হযরত মাওলানা মি'রাজুল হক রহ. (যিনি নফহাতুল আরবের লিখক ছিলেন) হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রহ. (করাচী) ও হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রহ. প্রমূখ উসতাযগণ ।
উল্লেখযোগ্য ছাত্রগণ : তার উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী, হযরত মাওলানা আবু তাহের জিহাদী, হযরত
মাওলানা রফিকুল ইসলাম (মুহাদ্দিস. জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ, ঢাকা)
হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক (শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া) হযরত মাওলানা আখতার ফারুক (আদীব. দারুল উলুম
আহসানিয়া মাদরাসা নারিন্দা ঢাকা) হযরত মাওলানা আলী নূর (খতীব সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) ও হযরত মাওলানা আবুর রহমান
(শায়খে দিঘলবাগী) অন্যতম।
পাঠদানকৃত কিতাবসমূহ : তিনি তার শিক্ষকতা জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য কিতাবের দরস দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে
শরহে জামী, মাইবুজী, সুল্লামুল উলুম, হামদুল্লাহ, কাযিখান, কাফিয়া,
তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে বাইজাভী, মুছাল্লামুছ ছুবুত ও বুখারী শরীফ ইত্যাদি।
তাঁর দরস দানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি কঠিন বিষয়গুলো বিভিন্ন উপমার সাহায্যে অতি সহজে শিক্ষার্থীদের সামনে পেশ করতে পারদর্শী ছিলেন। তা ছাড়া তর্কশাস্ত্রে তার অনেক দক্ষতা ছিল।
এরই বদৌলতে তিনি মুনাযারার জগতে ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং
বিদ'আতিদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার।
দ্বীন প্রচারে ভূমিকা : তিনি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করার ২৩ বছর
পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন তার নিজ গ্রামে হুসাইনিয়া কাসেমুল উলূম
নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দ্বীনী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল। কেননা এ
প্রতিষ্ঠানের বদৌলতেই অত্র এলাকার আপামর জনতা সহজেই দ্বীনী শিক্ষা
লাভের সুযোগ পেয়েছেন। তা ছাড়া দ্বীন প্রচারের লক্ষ্যেই তিনি ১৯৬৯
খৃষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অনন্য নযীর স্থাপন করে
ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা : মাওলানা আবুল হাশেম রহ. এর পিতা হাজী আব্দুস
সুবহান সাহেব ছিলেন আল্লাহর একজন পরহেগার বান্দা। যার সুবাদে
তার সন্তানগণ স্বভাবগতই ছিল দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে
হযরতের মাতা ইন্তিকাল করলে তাঁর জীবনে একটি আমূল পরিবর্তন
আসে। ফলে তার মাতার ইন্তিকালের অল্প দিনের মধ্যেই জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুহতামিম ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ. এর নিকট গমন করেন। দফতরে তিনি ফখরে বাঙ্গাল রহ.এর নিকট জানতে চাইলেন, এত বেশী বয়সে মাদরাসায় পড়ালেখা করা সম্ভব কিনা? ফখরে বাঙ্গাল রহ. তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ভর্তি হও । ইনশাআল্লাহ তোমার দ্বারা ইসলামের বড় খিদমত হবে। তার উৎসাহ উদ্দীপনায় ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভর্তি হন। তখন তার বয়স ছিল ৪১ বছর । তিনি ছিলেন ২
সন্তানের জনক ।
বিবাহ-শাদী ও সন্তান-সন্ততি : তিনি ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে নবীনগর থানাধীন
জালশুকা গ্রামের এক সম্ভান্ত পরিবারে বিবাহ করেন। তার ৪ ছেলে ও ২
মেয়ে।
এদের মধ্যে ১ম ছেলে এ.কে. ফজলুল হক । তিনি ২০০৭ খৃষ্টাব্দে
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসর গ্রহণ
করেন।
২য় ছেলে মাওলানা রফিকুল ইসলাম (মুহাদ্দিস, জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ, ঢাকা)।
৩য় ছেলে হাফো মাওলানা হুসাইন আহমদ। তিনি ১৯৯৪ খৃষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।
৪র্থ ছেলে মাওলানা আখতার
ফারুক (আদীব. দারুল উলুম আহসানিয়া মাদরাসা নারিন্দা, ঢাকা)।
ইন্তিকাল : তিনি ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দে ৩০ শে নভেম্বর বাদ ইশা তার নিজ বাড়িতে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৮৬ বছর।
হযরতকে তার নিজ গ্রাম খাকচাইলের কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার
জানাযার নামাযের ইমামতি করেন তার ২য় ছেলে মাওলানা রফিকুল
ইসলাম।
তথ্য সংগ্রহকারী
মাওলানা আখতার ফারুক
আদীব. দারুল উলুম আহসানিয়া মাদরাসা নারিন্দা ঢাকা
সাহেবযাদা. মাওলানা আবুল হাশেম রহ.
জীবনীসূত্র
মাশায়েখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জীবন ও কর্ম
লেখক, মুফতি ইহতিশামুল হক নোমান
মুহতামিম, মাদ্রাসা মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া, বনশ্রী, রামপুরা, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই