এই চিঠিটি আপনার জন্য

প্রিয় ভাইয়া, সালাম নিবেন। আশা করি ভালো আছেন।
আপনি আমার কাছে যে বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন সে বিষয়ে কথা বলার আগে দুটি উদাহরন দিই।

ধরুন আপনি রাশেদের কাছে গিয়ে বললেন,
 ভাই আপনিতো গেন্ডারিয়ার সেই ফুলের দোকান টা চিনেন। আমি সেখানে যেতে চাই , আমাকে একটু পথ বাতলে দেবেন?
উত্তরে রাশেদ বললো, আমার বলার দরকার কি, গুগল ম্যাপের সাহায্যে খুজে নাও অথবা ঢাকা শহরের কোন ম্যাপে খুঁজে দেখো। আশাকরি পেয়ে যাবে।
তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি বলবেন, আরে ভাই আপনি যেহেতু চেনেন বলে দিলেইতো হয়, এত ঝামেলার প্রয়োজন কী?

আপনি বকরের কাছে গিয়ে বললেন, ভাই আমার এক আত্মীয়ের টিউমার হয়েছে। কদিন আগে দেখেছিলাম তুইও এ নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করলি। বল না, এনিয়ে কোন ডাক্তারের কাছে যেতে পারি? তখন বকর বলল আরে, আমার বলার দরকার কী? নেটে সার্চ দে। সেখানেই ডাক্তার পেয়ে যাবি। তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি বলবেন, আরে ভাই তোর যদি ভালো ডাক্তারের ঠিকানা জানা থাকে তাহলে বলে দিলেইতো হয়। এত কষ্ট করে নেটে সার্চ দেয়ার কী প্রয়োজন?

প্রিয় ভাইয়া, আশা করি বুঝতে পেরেছেন, মানুষ যে বিষয়ে জানে না সে বিষয়ে যে জানে তার অনুসরণ করাই মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। অসুস্থ হলে আমরা ডাক্তারের কথা অনুসরণ করি। পড়াশোনার বেলায় শিক্ষকের কথা অনুসরণ করি। কোথাও ভ্রমণে গেলে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে পরামর্শ চাই। কিন্তু কেন?
ডাক্তারের কাছে গিয়ে টাকা নষ্ট না করে চিকিৎসা সম্বন্ধীয় বই কিনে আপনি নিজেই চিকিৎসা করুন। আইনি বিষয়ে পরামর্শের জন্য উকিলের পিছনে টাকা না ঢেলে কদিন কষ্ট করে আইনি কয়েকটি বই পড়ে ফেলুন। জমি মাপার সময় আমিনকে না ডেকে ভূমি জরিপ সম্পর্কে একটি বই নিয়ে আসুন। মন দিয়ে পড়ুন, বুঝুন, তারপর নিজের জমি নিজেই মেপে নিন।
প্রিয় ভাইয়া, আমরা কিন্তু এসবের কোনোটাই করিনা। এসব ক্ষেত্রে আমরা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ চাই। তাদের কথার অনুসরণ করি।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন‌, অনুসরণ করা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়।
দ্বীনি বিষয়ে এই অনুসরণকেই পরিভাষায় তাকলিদ বলে। তাকলিদ কোন নতুন বিষয় নয় বরং এ সম্পূর্ণ মানুষের স্বভাবজাত বিষয়।

ভাইয়া, আপনি যদি বলেন, দুনিয়াবী বিষয়ে কারো অনুসরণ করা গেলেও দ্বীনী বিষয়ে অনুসরণ করা শিরিক তাহলে আপনাকে আমি কোরানের একটি আয়াত শোনাতে চাই ,
وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ۚ
ইউসুফ আলাইহিস সালামের কাহিনী নিশ্চয়ই আপনি জানেন। জেলখানায় তিনি যখন তার সাথীকে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছিলেন তখন তিনি উপরোক্ত বাক্যটি বলেন। এর অর্থ কী?
এর অর্থ, "আমি আমার পিতামহ ইব্রাহীম ইসহাক ও ইয়াকুবের ধর্মের অনুসরণ করেছি"
ভাইয়া, এবার বলুন, ইউসুফ আলাইহিস সালাম নবী হয়েও কেন পিতামহের ধর্মের অনুসরণের কথা বললেন?
ধর্মীয় বিষয়ের অনুসরণ করা যদি শিরিকই হতো তাহলে একজন নবী হয়ে তিনি কি তবে….....

আচ্ছা ভাইয়া, আপনি তো কারো তাকলিদ না করে নিজেই কোরআন হাদিস অধ্যায়ন করে আমল করতে চান। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, এই যে দশ বছর ধরে আপনি নামাজ পড়ছেন এর কতগুলো মাসআলা আপনি সরাসরি কোরআন-হাদিসে পেয়েছেন আর কতগুলো মানুষকে দেখে শিখেছেন অথবা আহলে হাদিস ওলামায়ে কেরামের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন? তাহলে এক্ষেত্রেও কি আপনি তাদের অনুসরণ করছেন না?
আপনি যদি বুখারী শরীফ পড়ে থাকেন তাহলে দেখবেন বিভিন্ন স্থানে ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহ বলেছেন, হাসান বসরী রহ: একথা বলেছেন,কাতাদাহ এ কথা বলেছেন, ইবনে মুবারক এ কথা বলেছেন ......

প্রিয় ভাইয়া এরা কি নবী? না এরা নবীও নন সাহাবী ও নন বরং এরা তাবিয়ী। তাহলে তাদের কথা বুখারী রহ: তার সহীহ হাদীসের কিতাবে কেন আনলেন? এ কি ব্যক্তির অনুসরণ নয়?

আপনি যদি তিরমিজি শরীফ পড়ে থাকেন তাহলে দেখবেন ইমাম তিরমিজি রাহমাতুল্লাহ প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সে অধ্যায়ে বর্ণিত হাদিসের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মাযহাব উল্লেখ করেছেন। এই উল্লেখ কি শুধু সৌন্দর্য বা কিতাবের কলবর বৃদ্ধির জন্য?

প্রিয় ভাই এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার পর আশা করি তাকলীদ সম্পর্কে আপনার আর কোন প্রশ্ন থাকবে না।
এখন আপনি বলতে পারেন যদি তাকলীদ বা অনুসরণ করতেই হয় তবে শুধু একজন ইমামের অনুসরণ কেন করব? আমার কাছে যার কথা সঠিক মনে হবে আমি তারই অনুসরণ করব।

ভাইয়া, আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমাদের বাস্তব জীবনে আমরা নীতি নৈতিকতার উপর সাধারণত প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। পরীক্ষার হলে নকল করা কতটা নৈতিক? কিন্তু প্রয়োজনের সময় নকল করিনি একথা কি আপনি বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন? ধরুন রামপুরা যাওয়ার  দুটি রাস্তা আছে, একটি সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ আর অন্যটিতে দীর্ঘ জ্যাম। এখন আপনার যদি খুব দ্রুত রামপুরা যাওয়ার প্রয়োজন হয় আর সেই নিষিদ্ধ রাস্তায় পথ আটকানোর মত কেউ না থাকে তাহলে আপনি কোন পথ অনুসরণ করবেন? নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ পথ!
 প্রিয় ভাই, এভাবেই আমরা আমাদের জীবনে নীতি-নৈতিকতার পরিবর্তে প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এখন আপনি বলুন, যদি সবাইকে যে কোন ইমামের মত গ্রহণ করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে মানুষ কি অধিক সঠিক মতের অনুসরণ করবে নাকি তার সুবিধা অনুযায়ী মত গ্রহণ করবে?
 এভাবে কি দ্বীন একটি তামাশার বস্তুতে পরিণত হবে না? আর এভাবে চলতে থাকলে কি মুসলিম জাতির ঐক্য বাকি থাকবে?

 আরেকটি বিষয়, আপনি যে ভাবছেন, আপনি সবসময় সঠিক মত অনুসরণ করবেন, কিন্তু সঠিক মত যাচাইয়ের যোগ্যতা কি আপনার আছে? আজ কারো বাকচাতুর্য বিভ্রান্ত হয়ে আপনার কাছে মনে হবে এই মত সঠিক। পরের দিন আরেকজনের কথা শুনে আপনার কাছে মনে হবে এটাই সঠিক। এভাবে আপনি ঘুরপাক খাবেন। আর দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ে এভাবে সবার মতামত যাচাই করার মত সময়ও নিশ্চয়ই আপনার হবে না।

কোরআন হাদিস নিয়ে গবেষণা করার জন্য হাজারো ওলামায়ে কেরাম নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। তাদের ওপর আস্থা রাখুন। হালাল পথে রোজগার করুন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকুন। আমাদের নৈতিক চরিত্র গঠন করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য উপদেশ রয়েছে, অবসর সময়ে সেগুলো পড়ুন। নামাজে যে সূরা গুলো তেলাওয়াত করেন সেগুলোর অর্থ শেখার চেষ্টা করুন।
আর যে কাজের জন্য হাজারো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন সেকাজের পেছনে একজন সাধারণ মানুষের সময় ব্যয় করা অহেতুক নয় কি?

 প্রিয় ভাইয়া, আরো কথা বলার ছিল। তবে আজ নয়। আরেকদিন ইনশাআল্লাহ। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।
আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ

ইতি
আপনার একান্ত হিতাকাঙ্খী
মুহাম্মাদ ইলিয়াস হুসাইন

1 টি মন্তব্য:

nicodemos থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.