ফজরের জামাত চলাকালিন সুন্নত পড়ার বিধান
ওয়াক্তিয়া নামাযের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। এই নামাযের একটি বিধান হচ্ছে জামাতের সাথে আদায় করা। এটা ওয়াজিব। হাদীসে জামাতের প্রতি সবিশেষ উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং তাতে অবহেলার ব্যাপারে কঠোর সতর্ক করা হয়েছে।
এক হাদীসে আছে, জামাতের নামায একাকী নামাযের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি মর্যাদা রাখে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫০
অন্য হাদীসে আছে, কোনো এক নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোককে পেলেন না। বললেন, আমার ইচ্ছে হয়, কাউকে কাঠ-খড়ি আনতে বলি। তারপর আযান দিতে বলি। তারপর কাউকে নামায পড়াতে বলি। অতপর যারা জামাতে আসে না আমি তাদের কাছে যাই এবং কাঠ-খড়ি জ্বালিয়ে তাদেরসহ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫১
তার মধ্যে এশা ও ফজরের জামাতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এ দুই সময়ে মানুষ সাধারণত পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায় ও বিশ্রাম করে। ফলে জামাতদুটিতে যথেষ্ট অবহেলা ও গাফিলতি হয়ে থাকে। এজন্য হাদীসে এর প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।
উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ফজরের নামায পড়ালেন। সালাম ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কি আছে? লোকেরা বলল, জী না। তারপর আরেকজনের নাম নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কি আছে? লোকেরা বলল, জী না। তিনি বললেন, এ দুই নামায (এশা ও ফজর) মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। তোমরা যদি জানতে যে, এই দুই নামাযে কী পরিমাণ সওয়াব নিহিত রয়েছে, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে আসতে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৫৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৪৭৭
এমনিভাবে তাকবীরে উলা ও প্রথম কাতারেরও বেশ ফযীলত রয়েছে। এক হাদীসে আছে, জামাতের প্রথম কাতার (সম্মান ও মর্যাদায়) ফিরিশতাদের কাতারের অনুরূপ। তোমরা যদি জানতে যে, এটা কত মর্যাদাপূর্ণ তাহলে এর জন্য প্রতিযোগিতা করতে। -প্রাগুক্ত
অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে চল্লিশদিন তাকবীরে উলার সাথে জামাতে নামায আদায় করবে তার জন্য দুটি মুক্তিনামা লেখা হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং নিফাক থেকে মুক্তি। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১
সুতরাং নামাযের জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া কর্তব্য। যাতে ধীরস্থিরতার সাথে সুন্নত পড়া যায় এবং তাকবীরে উলার সাথে প্রথম কাতারে জামাতে নামায আদায় করা যায়।
কিন্তু কখনো যদি এমন হয় যে, ইকামত শুরু হয়ে গেছে বা নামায শুরু হয়ে গেছে, তাহলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্য সুন্নত হলে আর সুন্নতের নিয়ত বাঁধবে না; বরং জামাতে শরীক হয়ে যাওয়া জরুরি।
আর যদি ফজরের সুন্নত হয় এবং এ কথা মনে হয় যে, তা পড়ে জামাতের অন্তত এক রাকাত পাওয়া যাবে, তাহলে মসজিদের বাইরে তো তা নিঃসন্দেহে পড়া জায়েয; বরং পড়ে নেওয়াই উত্তম। এমনভিাবে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক কোণায় অথবা খুঁটির আড়ালে পড়াও জায়েয আছে। কিন্তু জামাতের কাতারে বা তার নিকটে পড়া মাকরূহে তাহরিমী।
সুন্নত নামাযের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত। হাদীসে এর প্রভূত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং এর প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যা অন্যান্য সুন্নতের ক্ষেত্রে হয়নি। এখানে ফজরের সুন্নত সম্বন্ধে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
(ক)
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ركعتا الفجر خير من الدنيا وما فيها .
ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৫
(খ)
তিনি আরো বর্ণনা করেছেন-
لم يكن النبي صلى الله عليه وسلم على شيء من النوافل أشد منه تعاهدا على ركعتي الفجر.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) নামাযে এত গুরুত্ব দিতেন যা অন্য কোনো নফল (বা সুন্নত) নামাযে দিতেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৪
(গ)
তিনি আরো বর্ণনা করেছেন-
صلى النبي صلى الله عليه وسلم العشاء، ثم صلى ثماني ركعات، وركعتين جالسا، وركعتين بين النداءين، ولم يكن يدعهما أبدا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার নামায পড়লেন। তারপর আট রাকাত নামায পড়লেন। তারপর বসে দুই রাকাত। তারপর আযান ও ইকামতের মধ্যে দুই রাকাত। এই দুই রাকাত তিনি কখনো বাদ দিতেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৫৯
(ঘ) আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لا تدعوهما، وإن طردتكم الخيل.
তোমরা এই দুই রাকাত কখনো ত্যাগ করো না, শত্রুবাহিনী তোমাদের তাড়া করলেও। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১২৫৮
(ঙ) আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। (এরপর তিনি পাঁচটি বিষয় বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে)-
…وركعتا الفجر حافظوا عليهما، فإنهما من الفضائل.
তোমরা ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত)-এর ব্যাপারে পুরোপুরি যত্নবান হও। কারণ তা ফযীলতপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৫৪৪
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট যে, ফজরের দু’রাকাত সুন্নত অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ এবং পারতপক্ষে তা ত্যাগ না করা উচিত।
এ কারণে বহু সংখ্যক সাহাবী-তাবেয়ী এমন ছিলেন, যারা কখনো যদি মসজিদে এসে দেখতেন যে, ফজরের ইকামত বা জামাত শুরু হয়ে গেছে, তাহলে মসজিদের ভেতরে জামাতের কাতার থেকে দূরে বারান্দায় বা মসজিদের এক প্রান্তে কিংবা খুঁটির আড়ালে ফজরের দু’রাকাত সুন্নত পড়ে নিতেন। তারপর জামাতে শরীক হতেন। আর কিছুসংখ্যক সাহাবী-তাবেয়ী মসজিদের ভেতরে তা পড়তেন না। তবে মসজিদের বাইরে ঘরে বা পথে অথবা মসজিদের দরজায় পড়তেন। তারপর ইমামের সাথে শরীক হতেন।
আল্লাহ সবাইকে জেনে বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন আমিন৷
কোন মন্তব্য নেই