মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী: একটি নক্ষত্র, একটি ইতিহাস
মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী
একটি নক্ষত্র, একটি ইতিহাস
লেখক: মুহাম্মাদ আব্দুল আজিজ
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ
এদিকে এটাও চরম বাস্তবতা, যে বিংশ শতাব্দিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ আগের যত ধর্ম,মতবাদ, দর্শন,জ্ঞান-বিজ্ঞান রয়েছে, সব কিছুতেই গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে৷ ইসলামও এর প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত থাকতে পারে নি৷
স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম-বিশ্ব চরমভাবে প্রভাবিত হয়৷ যার ফলে মুসলমানদের ঈমানে, আমলে মারাত্মক ধস নামে৷ অধপতনের শিকার হয়ে পড়ে মুসলিম জাতি৷ স্বাভাবিকই ইসলামের বিভিন্ন আইন,চিন্তাধারার উপর আপত্তি উত্থাপন শুরু হয়৷ উদাহরণ স্বরূপ,ছবি তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম৷ কিন্তু আপনি ছবি ছাড়া আধুনিক বিশ্বের কল্পনাই করতে পারেন না৷ তদ্রুপভাবে ধর্মান্তরের শাস্তি,গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা সমস্যা, নানা আপত্তি উত্থাপিত হতে থাকে৷
এতদ্বসত্ত্বেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রতি যুগেই ইসলামের হেফাজতের নিমিত্তে কিছু মনিষা পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেন,যারা সময়ের চ্যলেঞ্জ মোকাবেলা করে ইসলামকে দুনিয়ার বুকে উচ্চকিত করেছেন৷
যারা ইসলামের উপর আপতিত আপত্তি, ও প্রশ্নের দাতভাঙ্গা জবাব দিয়ে গেছেন৷ বিপরীত বাতাসের তীব্র আঘাত থেকে মাস্তুল ঠিক রাখতে পেরেছেন৷
এমন কয়েকজন বিরলপ্রজ প্রতিভাদের অন্যতম মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী রাহিমাহুল্লাহ৷
দুংখজনক হলেও সত্য, এ মহামনীষীকে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, দ্বীনী ধারায় সংযুক্ত শিক্ষিত ব্যাক্তিরাও চিনতে পারেননি৷ অধিকাংশই তাঁর ব্যাপারে কিছুই জানেন না৷ এ বিষয়টি সকরুণ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন মাওলানা শিবলী নোমানী রহ,৷ তিনি বলেন,সাধারণ নিয়ম হল,কারো যদি জ্ঞান-গরিমা থাকে; তা কখনো মানুষের কাছে গোপন থাকে না৷ এ ব্যাপক নিয়মের ব্যাতিক্রমও যে হয়,এর উত্তম উদাহরণ হলেন মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী৷
বিখ্যাত সীরাত-গবেষক,প্রথিতযশা সাহিত্যিক, মহান বুযুর্গ ব্যাক্তিত্ব আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নাদাভী রাহিমাহুল্লাহ উনার স্মৃতিচারণমূলক কিতাব “ইয়াদে রাফতেগাঁ” নামক কিতাবে লিখেন৷
“ ১১ই নভেম্বর ১৯৩০ ঈসায়ীতে এ যুগের ইবনে তাইমিয়া মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী আমাদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন৷ ভবিষ্যতে এমন ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷ যিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জ্ঞানের সমন্বয়কারী জীবন্ত মুজিযা ছিলেন৷ আরবী ভাষার সাহিত্যিক, ইংরেজিতে গ্রাজুয়েট, সততা-আদর্শের মূর্তপ্রতিক, যুহদ-তাক্বওয়ার উজ্জ্বল নমুনা,কুরআনের মুফাসসির,কুরআনের তত্বজ্ঞানী,রহস্যভেদী,ইলমের জগতের নীরব বাদশাহ,দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব থেকে দূর,বহুদূর, দর্শনশাস্ত্রের অভিজ্ঞ পন্ডিত, এতসব গুণের আধার এ মহামনীষী৷
তিনি সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর লাগাতার কুরআন বুঝতে,কুরআনের গবেষণায় কাটিয়েছেন৷
কুরআনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তৃত উদ্যানে প্রাণভরে বিচরণ করেছেন৷ কুরআনের অকূল সমুদ্রে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন অসংখ্য হিরে মতি পান্না৷ তবে দুংখের বিষয় হল,তাঁর এ বিস্তৃত ইলম ‘সিনা’ থেকে ‘সাফিনায়’ এসেছে অনেক কম৷ তাই জাতি উনার ততটা মূল্যায়ন করতে পারেনি৷”
এ মহান মনীষী ১৮৬৪ সনে ভারতের রত্নগর্ভা, স্বর্ণপ্রসবা ভূমি আজমগড়ে জন্মগ্রহন করেন৷
দশ বছর বয়সেই কুরআন হিফজ করেন৷ এরপর নিজ এলাকায় একজন মাওলানার কাছে ফারসি সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন৷ মাত্র ষোল বছর বয়সে ফারসি সাহিত্যের উচ্চাঙ্গের কবিতা লেখার যোগ্য হয়ে উঠেন৷ সে সময় তিনি বিখ্যাত ফারসি কবি খাকানী রহ, এর অনুকরণে একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন৷ মাওলানা শিবলী নোমানী রহ, তাঁর ফুফাতো ভাই ছিলেন৷ তিনি মাওলানার ফারসি সাহিত্যের উস্তাদ মাওলানা মাহদি হাসানকে কবিতাগুলো দেখিয়ে বললেন,হযরত, বলুন তো এগুলো কার কবিতা?? তিনি জবাবে বললেন,শিউর করে তো বলতে পারছি না; তবে প্রাচিন কোন ফার্সি সাহিত্যিকের কবিতা হবে৷ মাওলানা শিবলী বললেন, হযরত, এগুলো তো হামিদের লেখা৷ মাওলানা বিস্ময়ে থ বনে গেলেন৷ এত তুখোড় মেধার অধিকারী ছিলেন যে খোদ উস্তাদও ধরতে পারেননি৷ বিশ বছর বয়সে দ্বীনী উলুম থেকে ফারিগ হন৷ অতঃপর উচ্চতর আরবী সাহিত্য শেখার জন্য তৎকালিন ভারতের বড় বড় জ্ঞানকেন্দ্রে সফর করেন৷ তার উস্তাদদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা শিবলী নোমানী,মাওলানা আব্দুল হাই ফিরিঙ্গিমহল্লী,মাওলানা ফয়যুল হাসান সাহারানপুরী৷ এরপর আধুনিক জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক আলিগড়ে বি এ তে ভর্তি হন৷ সে সময় ইংরেজি শিক্ষা রীতিমত কুফরি মনে করা হত৷ তিনিই এ ধারণা ভাঙেন৷ সেসময় আলিগড়ের পূর্ণ যৌবনকাল৷ স্যার সৈয়দ মরহুম তখন জীবিত৷ আলিগড়ে তখন নিয়ম ছিল, আরবী ফারসি পড়া বাধ্যতামূলক৷ মাওলানার ব্যাপারে স্যার সৈয়দ লিখে দিলেন,আপনারা যারা আরবী ফার্সির প্রফেসর, তারা যে পরিমাণ আরবী ফার্সী জানেন; হামিদুদ্দীন তার চে কোন অংশে কম নন৷ সুতরাং হামিদ এ নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম৷ তিনি পুরো সময় ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন৷সেখানে তিনি প্রসিদ্ধ ইংরেজ দার্শনিক ‘অরনাল্ড'এর কাছে দর্শনের পাঠ নেন৷ তার কাছে দর্শন পড়ে তিনি ইংরেজ,ফরাসী দার্শনিকদের চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ হন৷ সেসময় অতি অল্পসময়ে তিনি হিব্রু ভাষা শিখে ফেলেন৷ যা সত্যিই বিস্ময়কর ছিল৷ তখন মুসলিম পণ্ডিতরা ইংরেজ দার্শনিকদের জবাব দিতেন মানুষের কাছ থেকে শুনে শুনে৷ তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি পক্ষে-বিপক্ষে যাই লিখেছেন নিজস্ব অধ্যয়ন ও গবেষণার ভিত্তিতে লিখেছেন৷ ইংরেজি ভাষায় অর্জন করলেন অসামান্য পান্ডিত্য৷ কৃতিত্বের সঙ্গেই তিনি শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন৷
আলিগড়ে এসে তিনি ইসলামের উপর আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কতৃক সৃষ্ট আপত্তিগুলো জানতে পারেন৷ তিনি লক্ষ্য করলেন, মানুষ এগুলোর উত্তর দেবার মত জ্ঞান, ভাষা,সাহিত্যের উপযুক্ত ব্যকগ্রাউন্ড না থাকায় জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে,কুরআনে কারিমের অর্থ-মর্মে ব্যাপক বিকৃতি সাধন করছে৷ সেটা ছিল আলিগড়ের সেসময়, যখন স্যার সৈয়দ মরহুম কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের,ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের মনগড়া সব ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন৷
সেসময়ের কথা লিখতে গিয়ে তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী লিখেন:
“যে সময় আলীগড়ে স্যার সৈয়দ মারহুম পাশ্চাত্য মতবাদে প্রভাবিত হয়ে কুরআনের মনগড়া ব্যাখা শুরু করলেন৷ সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানরাও পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনার জঘণ্যভাবে শিকার হল৷ মাওলানা রহ, এটাকে যেমনিভাবে ইংরেজদের জবরদখলের কুদরতী ফলাফল মনে করলেন,তেমনি এর মৌলিক কারণ চিহ্নিত করারও প্রয়াস পেলেন৷ তিনি কুরআন অধ্যয়নের স্বাভাবিক পন্থা ‘তাফসির দেখে কুরআন গবেষণা’ এটা বাদ দিয়ে নিজের পক্ষ থেকে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা আরম্ভ করেন৷ এর মাধ্যমে তিনি ঐসব মৌলনীতি পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হন, যা তিনি নিযামুল কুরআনের ভূমিকায় লিখেছেন৷”
এ ছিল তার প্রিয় শাগরিদ আমিন আহসান ইসলাহীর বক্তব্য৷ সাইয়্যেদ সুলাইমান নদবী রাহিমাহুল্লাহ আরো লিখেছেন, তিনি স্বভাবজাত তুখোড় মেধাবী ছিলেন৷ একবার পড়েই বিষয়ের গভীরে পৌঁছে যেতে পারতেন৷ যাই পড়তেন দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারতেন৷
শিক্ষক-জীবন
আলিগড় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি সর্বপ্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন করাচির সিন্ধু মাদ্রাসায়৷ সেখানে তিনি ১৮৯৪ থেকে ১৯০৩ পর্যন্ত দশবছর শিক্ষকতা করেন৷ এখানেই তিনি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সুযোগ পান৷ তার তাফসির গ্রন্থের রচনার সূচনাও এখান থেকে হয়৷ এখান থেকে বের হয়ে হায়দারাবাদ উসমানিয়া কলেজে শিক্ষকতা করেন৷ এছাড়াও কয়েকটি নামিদামি কলেজে অধ্যাপনা করেন৷ শেষ-জীবনে নিজ প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা “ইসলাহুল মুসলিমিন” সারায়ে মীরে চলে আসেন৷ আমৃত্যু সে প্রতিষ্ঠানটি দেখাশোনা করেন৷ এখান থেকেই তিনি কিছু ছাত্র তৈরী করার চেষ্টা করেন৷ এর মধ্যে মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী সবিশেষ উল্লেখযোগ্য৷
ওফাত
এ মহামনীষী এত বড় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন৷ সাধারণ চালচলনে তাকে আলিম বলেই মনে হত না৷ খ্যাতির মোহ অত্যন্ত অপছন্দ করতেন৷ দুনিয়া-বিমুখতার মত মহানেয়ামত তিনি লাভ করেছিলেন৷ এত বড় আলিম হওয়া সত্ত্বেও নিজের জন্য কোন আলিমসুলভ উপাধি গ্রহণ করা পছন্দ করতেন না৷ তিনি শুধুমাত্র মুআল্লিম উপাধিটি ব্যবহার করতেন৷ তার আরবী কিতাবগুলোর মধ্যে লিখতেন, মুআল্লিম আবদুল হামিদ আল ফারাহী৷ যেহেতু ‘হামিদুদ্দীন’ আরবীতে উপাধিস্বরূপ মনে করা হয়,তাই আব্দুল হামিদ লিখতেন৷ ইলম ও আমলের এ জাহায ১৯৩০ সনের ১১ই নভেম্বর আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহধাম ত্যাগ করেন৷ জীবিত থাকতেই মাগফিরাতের একাধিক ইশারা পেয়েছিলেন৷
রচনাবলী
তিনি দশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন৷ অধিকাংশই এখনো পাণ্ডুলিপি আকারে রয়ে গেছে৷ অধিকাংশ কিতাবই আরবীতে লিখেছেন৷ ফার্সী ভাষায়ও লিখেছেন বেশ কিছু৷ দুংখজনক কারণে তাঁর রচনাবলী আমরা পাইনি৷ অবশ্যই তার তাফসিরের কয়েকখন্ড ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে৷ নিযামুল কুরআন আরবী ভাষায় মুদ্রিত হয়েছে৷ মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহীর “তাদাব্বুরে কুরআন”ও মূলত ফারাহিরই প্রতিনিধিত্ব করে৷
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার কবরকে আলোকিত করুন, তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকামে অধিষ্ঠিত করুন৷
آسماں ان کی لحد پر شبنم افشانی کرے.
سبزہ نورستہ اس گھر کی نگہبانی کرے.
কোন মন্তব্য নেই