আকাবির জীবনচরিত পর্বঃ ১
بسم ﷲ الرحمن الرحيم
উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী মাওলানা আবুল কাসিম নুমানি দাঃবাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী৷
লেখক: মিজানুর রহমান
শিক্ষার্থী : দারুল উলুম দেওবন্দ
উলামায়ে দেওবন্দ দেড়শ বছর ধরে দীন-ধর্ম এবং ইলম ও আমলের প্রতিবিম্ব স্থাপন করে রেখেছেন দুনিয়াজুড়ে ৷ পৃথিবীর বুকে ছায়াদার ফলদার বৃক্ষের ন্যায় জ্ঞানের দীপাধার নিয়ে দাড়িয়ে আছেন যুগ যুগ ধরে ৷ মহান প্রভুর দেয়া জ্ঞানের আলোতে আলোকময় করেছেন পুরো বিশ্বকে ৷
নিঃসন্দেহে উলামায়ে দেওবন্দ উম্মাহর একটি নির্বাচিত কাফেলা যারা নিজের সবটুকু বিলীন করে দিয়েছেন আল্লাহর পথে, দীনের জন্য ৷ ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন, ইতিহাস কোনোটাই বাদ পড়েনি তাঁদের পরিব্যাপ্ত জীবন কর্ম থেকে ৷
নিরবে, নিরালয়ে সমাজের হীতে, বিশ্ব সংসারের কুশল কামনায়, বিদআত, কুসংস্কারমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে যারা তিলে তিলে বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের পুরো জীবন৷ নিজেদের সবটুকু শ্রম ও নিরলস সাধনা ব্যায় করে দীন রক্ষায় যারা বদ্ধপরিকর৷ ফলে যশ-খ্যাতি তাঁদের গলায় মালা পরিয়ে দেয় মানবতার টানে ৷ তারা চির নন্দিত,পরম সমাদৃত ৷
আমাদের এবারের আয়োজন এ মুবারক কাফেলার এক মহা মনিষার জীবন চরিত নিয়ে ৷ তিনি আমাদের সবার হৃদয়ের স্পন্দন, মুরশিদে মিল্লাত মুফতি আবুল কাসিম নুমানি দাঃ বাঃ ৷ মুহতামিম ও মুহাদ্দিস, দারুল উলুম দেওবন্দ ৷
নাম ও জন্ম :---
নামজাদা, প্রথিতযশা,বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দীন মাওলানা নুমানির জন্ম উত্তর প্রদেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শহর বেনারসে ২২ শে সফর ১৩৬৬ হিজরি মুতাবেক ১৯৪৭ সনে মদনপুর মহল্লার এক অভিজাত খান্দানে ৷ যে বেনারস ইলম ও আমল, সাহিত্য - সংস্কৃতি তে দেশজুড়ে প্রসিদ্ধ ও ভারতীয় মুসলমানদের মর্যাদার কেন্দ্রবিন্দু ৷
প্রাথমিক শিক্ষা :---
মাওলানা নুমানি ইবতিদায়ি তথা প্রাথমিক শিক্ষা নিজ পরিবারেই অর্জন করেন ৷ স্নেহময়ী মা ও শ্রদ্ধেয় দাদাজান মরহুম মাওলানা কারি নিজামুদ্দিন রহঃ এর কাছে কায়েদায়ে বুগদাদি, নাজেরায়ে কুরআন, এবং উর্দু অংকের প্রাথমিক কিতাবাদি আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেন ৷
এরপর নিজ গ্রামে জামিআ ইসলামিয়া মদনপুরে প্রাইমারী দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ৷ প্রাইমারী শেষ করে আরবী প্রথম বর্ষ-ও সেখানে সমাপ্ত করেন ৷ অতঃপর চলে যান দারুল উলুম ,মিউতে ৷ সেখানে পূর্ণ কৃতিত্বের সঙ্গে আরবি তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত শেষ করেন ৷
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দে গমন :---
1382 হিজরির শাওয়ালে মাওলানা নু ‘মানী জ্ঞান ভান্ডারের মাতৃক্রোড় উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে আরবী চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হয়ে এ মহান ইদারায় শিক্ষার্জনের সৌভাগ্য অর্জন করেন ৷ ঐ বছর দারুল উলুমে শতবর্ষি সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ৷ পড়ালেখা, কৃতিত্বে ঈর্ষণীয় সাফল্যের সাথে 1387 হিজরীতে সর্বোচ্চ নাম্বার অর্জন করে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন ৷ ফারাগাতের পর একবছর তাকমীলে ইফতার কোর্সও সম্পন্ন করেন ৷
তিনি দারুল উলুমে শান্ত, সুবোধ, মার্জিত চরিত্রের অধিকারী, মেধাবী ছাত্র হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন ৷ আরবী ও উর্দূ সাহিত্যে তাঁর যোগ্যতা ছিল স্বভাব যাত ৷ জ্ঞানোদ্যান দারুল উলুম তা আরো শানিত করে তুলল ৷ তাঁর যোগ্যতা, অসাধারণ প্রতিভা ছড়িয়ে যায় শিক্ষক ছাত্র সর্ব মহলে ৷ দারুল উলুমের ইলমী আঙ্গিনায় এর বেশ চর্চা শুরু হয় ৷
আরবী সাহিত্যে অসম্ভব দক্ষতার কারনে আসাতিযায়ে কিরামের অন্তরে প্রিয় ছাত্রের বিরল প্রতিভার প্রতি পূর্ণ ভরসা জন্মে ৷ ফলে তাকমীলে ইফতার বছর মাওলানা ওয়াহীদুয যামান কিরানবী রহঃ এর নির্বাচনে আরবী সাহিত্যে পাঠদান করেন তিনি ৷ তাঁর তখনকার ছাত্রদের অন্যতম হলেন বিশ্ব নন্দিত আরবী সাহিত্যিক মাওলানা নুর আলম খলীল আমিনী দাঃ বাঃ ৷
আধ্যাত্মিকতা :---
জ্ঞানের আঁধার, ইলম ও আমলের সমাহার এ সুমহান ব্যক্তিত্ব ছাত্র জীবনেই মিশকাতের বছর যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদীস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবীর হাতে বাইয়াত হন ৷ কিন্তু কিছুদিন পর হজরতের ইন্তেকাল হয়ে যায় ৷ অতপর তিনি ফকীহুল উম্মত মুফতি মাহমুদুল হাসান গাঙ্গুহী রঃ এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন ৷ এবং হজরতের কাছেই ইজাজতপ্রাপ্ত হন ৷ নিজের সবটুকু উজাড় করে প্রিয় শাইখের খিদমাতে আত্মনিবিষ্ট হন ৷ তিনি হযরতের আজাল্লে খুৃলাফাদের একজন ৷ এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকায় শাইখের ইন্তিকালে জানাজার জন্য হজরতকে ইমাম বানানো হয় ৷
অধ্যাপনা ও কর্মজীবন :---
1389 হিজরী মুতাবেক 1969 ইংরেজিতে দারুল উলুম থেকে একাড়েমিক শিক্ষা সমাপনের পর জামিআ ইসলামিয়া, রিউড়ি পুকুর, বেনারসে শিক্ষকতা শুরু করেন ৷ 2011 ইংরেজিতে দারুল উলুমের ইহতিমামের ভার গ্রহণের আগ পর্যন্ত উক্ত মাদরাসাতেই সাফল্যের সাথে পাঠ দান পরিচালনা করেন ৷ সুদীর্ঘ সময় শাইখুল হাদীসের পদ অলংকৃত করে ছিলেন ৷
বেনারসে বিদআদ- রুসুমাতের খুব প্রচলন ছিল ৷ মাওলানা একা তা মূলোৎপাটনের সংকল্প করে কাজ শুরু করেন ৷ দাওয়াহ, ইসলাহ, ও ইরশাদের মায়দানে নিরলশ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান দুই যুগেরও বেশি সময় ৷ প্রতিকুল পরিবেশে দ্বীন- ধর্মের বাণী পৌঁছে দিতে বিছানাপত্র, মাইক, চাটাই নিয়ে নিজেই ছুটে যেতেন জন সাধারণের দ্বারে দ্বারে ৷ পুরো সপ্তাহ মেহনাত করে কারো ঘরে মাহফিলের আয়োজন করতেন ৷ তিলাওয়াত, নাশীদ, আলোচনা সব নিজেকেই করতে হত ৷
ইসলাহী কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার লক্ষে তিনি -আন্জুমানে ইসলাহুল মুসলিমীন-নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ৷ পাশাপাশি নিজ এলাকা মদনপুরে স্বীয় মুরশিদের নামে খনকায়ে মাহমুদিয়া প্রতিষ্ঠা করেন ৷ যেখানে তিনি বাইয়াত ও সুলুকের সাথে দরসে কুরআন ও দরসে হাদীসেরও ব্যবস্থা করেন ৷ এ ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে ৷ বর্তমানে মাওলানার মুরিদান ও মুতাআল্লিকীনদের সংখ্যা কয়েক হাজারে ঠেকেছে ৷ তাঁর ফুয়ুজ শুধু ভারতে নয় বরং পুরো পৃথিবীর দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে৷
দারুল উলুমের সাথে সম্পৃক্ততা :---
1992 সনে মাওলানা কে দারুল উলুমের ব্যবস্থাপনার কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে মাজলিসে শুরা ও মাজলিসে আমেলার সদস্য পদে নিযুক্ত করা হয় ৷ 2011 পর্যন্ত সুদীর্ঘ বিশ বছর এ ধরাবাহিকতা অব্যাহত ছিল ৷ 2011 এর জুলাই মাসে তখনকার মুহতামিম মাওলানা মারগুবুর রহমান সাহেবের ইন্তেকালের পর পরিচালনা কমিটি হযরতকে নির্বাহী মুহতামিম হিসেবে নিযুক্ত করেন ৷ মাওলানা নির্বাচিত হওয়ায় কয়েকদিনের মাথায় আলহামদুলিল্লাহ পরিস্থিতি পরিপূর্ণ শান্ত হয়ে যায় ৷
ইসলামি আন্দোলন :---
মাওলানা নু‘মানি ইসলামি আন্দোলনেও একজন প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব ৷ ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অঞ্চল ও প্রদেশ ভিত্তিক বহু কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এখন দারুল উলুমের ইহতেমামের গুরুদায়িত্বের কারনে মাঠ পর্যায়ে যদিও সক্রিয় নন তিনি৷ তবু জমিয়তের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ব্যক্ত করে মাঝে মাঝে বলেন- আমি তো শৈশব থেকেই জমিয়তের সদস্য আছি ৷ পৃথক হব কিভাবে ? -
লেখালিখি ও রচনা সমগ্র :---
শিক্ষকতা,মুহাদ্দেসি, ইহতিমাম এত সব ব্যস্ততার পাশাপাশি লেখালিখি অনেকটা কঠিন ব্যাপার ৷ তদুপরি হজ,ওমরার মাসাঈল, মা‘মুলাতে ইয়াওমিয়াহ, সহ জাতীয় দৈনিক, মাসিক, সপ্তাহিক সাময়িকীতে প্রকাশিত,এবং বিভিন্ন কনফারেন্সে প্রদত্ত বিষয় ভিত্তিক, গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ-নিবন্ধ তাঁর জীবনের মূল্যবান পুঁজি ৷
,রিউড়ি পুকুর, জামিআ ইসলামিয়াতে মাওলানা দীর্ঘদিন সহীহ বুখারীর দরস দেন ৷ হযরতের দরসী তাকরীর,আসবাকে হাদীস নামে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হতে চলেছে ৷ প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়ে দ্বিতীয় খন্ড আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় ৷
হযরতের বিষয় ভিত্তিক প্রবন্ধ - নিবন্ধ মাকালাতে নু‘মানি, এবং বিভিন্ন মাহফিলের বয়ান সংকলন মাওয়ায়েযে নু‘মানী নামে সদ্য প্রকাশিত হয়ে উলামা,তুলাবা ও জনসাধারণ সর্ব মহলে বিপুল সমাদৃত হয়েছে ৷
উলামায়ে দেওবন্দের কিংবদন্তি সিপাহসালার, উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী, মুরশিদে মিল্লাত মুফতি আবুল কাসিম নু‘মানী দাঃ বাঃ বর্তমানে ইহতিমামের পাশাপাশি তিরমিযী শরীফ প্রথম খন্ডের পাঠদানও করছেন ঈর্ষণীয় দক্ষতার সঙ্গে ৷ হযরতের নেতৃত্বে দারুল উলুমের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক, সাফল্যের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করুক এ কামনা করি ৷ পরিশেষে রব্বে কারীমের দরবারে হযরতের সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘ নেক হায়াত কামনা করি৷
মিজানুর রহমান
শিক্ষার্থী : দারুল উলুম দেওবন্দ ৷
কোন মন্তব্য নেই